ঈশানী পাড়ের ইতিকথা (ঐতিহাসিক) — সুদীপ ঘোষাল – পর্ব – ৮

ঈশানী পাড়ের ইতিকথা (ঐতিহাসিক) -- সুদীপ ঘোষাল - পর্ব - ৮
—–তা হলে কি করা যায় বলো তো। মেয়েটা তো মরেই গেছে। তাছাড়া আমি বুড়ি। এই বয়সে আমি অত ধকল সইতে পারবো না। তুমি যা ভালো বোঝো করো। আমাকে বাঁচাও।
—–ঠিক ভেবেছেন আপনি। আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি দিল দিয়েছিলাম ওকে। আমার কথা মনে করলো না ও। কি নিষ্ঠুর তুমি অনুপমা।
ঠাকুমা রাজুর চোখ মুছিয়ে দিলেন। বললেন,যা হয়েছে,তা আর ফিরে আসবে না। তুমি পাড়ার লোক ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাও।
রাজু তার দলবল নিয়ে পাড়ার লোকদের বললো,আপনারাই বলুন। একা বুড়ি মানুষ পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইছে না। তাহলে আমরা কি মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবো। পাড়ার সব লোক ফিসফাস করলো। কেউ ঝামেলায় থাকবে না। একজন বয়স্ক মহিলা বললেন,নিয়ে যাও,ওর ঠাকুমাই তো মালিক। উনি যা বলবেন,তাই করো। আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?
রাজু ভাবছে এখনও  শালি, বুড়িটা টাকা দিলো না। মদ, মাংস খেতে হবে। পাড়ার লোক,বন্ধু,বান্ধব,শ্মশান খরচ খানকি বুড়ি…
—–তা হলে,ঠাকুমা, চাঁদা তুলি।
——আরে,ছি,ছি বলো কি? টাকার কোনো অভাব নেই। যত লাগে দেবো। সব তো নাতনির জন্যই রাখা আছে।
দশ মিনিট পরে ঠাকুমা রাজুর হাতে কুড়ি হাজার টাকা দিলেন। বললেন,আরও লাগলে দেবো। টাকার কোনো অভাব নেই।
রাজু টাকা নেয় আর ভাবে,শালি,আমার বাবার কাছে ঝারা মাল। আমার বাবাকে খুন করেছে তোর স্বামী। তার ফল ভোগ কর শালি,খানকি।
তারপর হাসি হাসি মুখে বলে,আর কোনো চিন্তা নেই। আপনি চেয়ারে বসে দেখুন।
রাজুর নেতৃত্বে তার দল আমগাছে উঠে লাশ পারলো। ট্রাকটর চলে এলো। কুড়িজন লোক সঙ্গে করে চলে গেলো শ্মশানে।
বন্ধুকে আড়ালে বলছে রাজু,শালা এবার বুড়ির পালা। তারপর ওই জায়গায় গজিয়ে উঠবে আমাদের আড্ডা। শালা প্রথমে ক্লাব হবে,পাশে মন্দির হবে।
রাজু বলে উঠলো,বল্লো হরি…
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,হরিবোল…
আবার বল্লো,…
           (আট)
ঈশানী নদীর সঙ্গে অজয় নদীর ভারি ভাব।বন্যা এলে অজয় নদ আর ঈশানী নদী প্রেম সোহাগে সব ভাসিয়ে দেয়।
একবার বন্যায় স্টেশনে নেমে সমর দেখলো শুধু জল আর জল।যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু জলের ঢেউ।ভেসে যাচ্ছে খড়ের চাল,বাসনপত্র,গোরু,মোষ,ছাগলের দল।আর একটু পরেই স্টেশনে জল উঠে পড়বে।আশ্বিন মাসে প্রতিবার সমর পুজোর কেনাকাটি করে গ্রামে আসে।জল প্রায় প্ল্যাটফরম ছুঁই ছুঁই।সমর সতর্ক হলো।একটা গ্রামের ছেলে এসে বললো,সমরদা বাড়ি এলে।কিন্তু যাবে কি করে? সমর বললো,তোর মালপত্র কিছু আছে নাকি?গ্রামের ছেলেটির নাম রঘু।
সে বললো,আমি বন্যার জল দেখতে এসেছি। সমর বললো,আমার এই ব্যাগ দুটো নিয়ে যেতে পারবি। তোকে পাঁচশো টাকা বখশিস দেবো।রঘু রাজি হলো। বললো,তোমার যতগুলো ব্যাগ আছে আমাকে দাও। সমর বললো,তার প্রয়োজন নেই। তুই দুটো নিবি। আমি দুটো নেবো। কাঁধে ঝুলিয়ে নে। তারপর ওরা গাছ থেকে দুটো শক্ত ডাল ভেঙ্গে নিলো।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে ওরা নেমে পরলো বন্যার জলে। কোমর অবধি জল। রঘু আগে আগে চললো।সমর বললো,তোর ভয় নেই। স্রোত বেশি হলে আমি তোকে ধরবো।হঠাৎ একটা সাপ ওদের কাছে ভেসে চলে এলো। বেশ বড় শাঁখামুটি সাপ।রঘু বলে উঠলো,বাবা গো। সমর লাঠি দিয়ে সাপটাকে একপাশে স্রোতের মুখে ঠেলে দিলো। সাপটা ভাসতে ভাসতে চলে গেলো দূরে।
প্রায় দুঘন্টা পরে ওরা গ্রামে এলো।গ্রাম চেনা যাচ্ছে না। সমর দেখলো,মাটির বাড়ি সব ভেঙ্গে গেছে। গ্রামটা কেমন ফাঁকা লাগছে। সমরদের একতলা পাকা বাড়ি। কিন্তু ঘরে জল ঢুকেছে। তাই ছাদে ত্রিপল টাঙিয়ে বাড়ির আত্মীয়স্বজন সব আছে। সমর রঘুকে টাকাটা দিয়ে ব্যাগগুলো ভাইয়ের হাতে দিলো।তারপর ছাদে উঠে গেলো।বৃষ্টি শুরু হলো আবার। রেডিও খবরে শুনলো সমর,বৃষ্টি আরও তিনদিন হবে।এক লাখ কিউসেক জল ছেড়েছে। বন্যার জল আরও বাড়তে পারে। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ে,গুড় ফেলা হচ্ছে বন্যার্তদের জন্য।সতর্ক বার্তা জারি হয়েছে রাজ্যবাসীর জন্য।
 সমর রেডিও বন্ধ করে ভিজে জামা কাপড় ছেড়ে চা খেলো।বাড়ির সকলের সমরকে দেখে খুব আনন্দ।কিন্তু দুর্গাপুজোর আগে বন্যার জন্য সব আনন্দ জলে গেলো। সমরের ভাই অমর বললো,পুজো বাড়ির ঠাকুর জলে ভিজে গেছে। অসুরের রঙ উঠে গেছে। আবার রঙ দিতে হবে নতুন করে। সমরের বাবা ব্যাগ খুলে দেখছেন,ছেলে কি বাজার করেছে।জামা,প্যান্ট, কাপড়,ধূতিসব সুন্দর হয়েছে।সমরের বাবা খুব খুশি।তিনি বললেন,কাজের মেয়ে রাণী আর মুড়ি ভাজুনির জন্য কাপড় এনেছিস তো?সমর বললো,হ্যাঁ,দেখো অন্য ব্যাগে আছে।
বাবকে খুব শ্রদ্ধা করতো সমর। তাই বাবার আদেশ মান্য করে শত বাধা অতিক্রম করে ভাইকে নিয়ে সে বাবার কাছে এসেছে। বাবা কত কষ্ট করেছেন তাদের মানুষ করতে। গোমো থেকে হাওড়া ছুটে বেড়িয়েছেন এক কালে। এখন বুড়ো হয়েছেন। বাবাকে তাই কোনো দুঃখ দিতে চায় না সমর।
সমর গ্রামে বের হলে দেখলো বি রাজুলের ঘর নেই।সন্তু জলে দাঁড়িয়ে, রাজু,অনুপমা,দাদুর আমগাছে।দাদুর জনপতি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে   যায় এই বন্যায়।সমর ছোটো থেকে বাইরে থাকে।তার জানাশোনা বড়ো বড়ো লোক আছে।
সন্তু বল, তুমি আমাদেরকে শহরে নিয়ে চলো সমরদা।বিরাজুল বললো,না আমরা সবাই এক হয়ে আবার গ্রাম নতুন করে গড়ে তুলবো।গ্রামের সবাই একমত হলো।সমরও সমর্থন করলো।সমর বললো,এবার বাঁধ হবে।নবীন জোয়ারের ফলে এক বছরের মধ্যে গ্রাম নব সাজে সেজে উঠলো।ভারতীয় গ্রামের মায়া ঘিরে ধরলো নব সভ্যতার শিকড়।
শেষ
 

সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০                    

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *