ইমপোস্টার – পর্ব ১ : সুব্রত মজুমদার

 এক


“হাই, আমি বিক্রম মুখোপাধ্যায়, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।”  বিক্রম হাতটা সামনের দিকে এগিয়ে দিল।  মেয়েটি সামনের রবীন্দ্রনাথ মার্কা লোকটা দু’হাত জোড় করে বলল, “নমস্কার। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমি প্রফেসর লোমহর্ষণ । আমার সাবজেক্টটা আপনার মতোই তবে আরও সূক্ষ্ম। আপনি বিশ্লেষণ করেন যুক্তির আধারে আর আমি চাক্ষুষ প্রমাণের। আমি একজন বিজ্ঞানসেবক । “


-“জানি। ভটচায মশাইয়ের কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। তবে কি জানেন প্রফেসর গোয়েন্দাগিরির কাজেও চাক্ষুষ প্রমাণেরও দরকার হয় । কোর্ট কিন্তু শুধু যুক্তি আর বিশ্লেষণের ধার ধারে না। ” বিক্রম মন্তব্য করল। প্রফেসর মৃদু হেসে বলল,”ইউ আর রাইট মিস্টার ডিটেকটিভ।” হাল্কা হাওয়াতে তার দাড়ি মৃদু মৃদু নড়তে লাগল। 


চৈত্রের অলস দুপুরে একটা কফিসপের সামনাসামনি দুটো চেয়ারে দুজন, বিক্রম আর প্রফেসর লোমহর্ষণ । পাশের চেয়ারদুটোতে আমি আর অঘোরবাবু। প্রফেসরের সঙ্গে বিক্রমের কথাবার্তা চলছে, আমরা শ্রোতা মাত্র । ওদের কথোপকথনের সূত্র ধরেই জানতে পারলাম প্রফেসরও অনেকগুলো কেস সলভ করেছেন , তবে সেই কেসগুলো ঠিক সেই অর্থে ক্রিমিনাল অ্যক্টিভিটি ছিল না, – ওগুলো বিজ্ঞান রিলেটেড মিস্ট্রি ।


             বিক্রমের সঙ্গে এই প্রথম দেখা তার । প্রফেসর লোমহর্ষণ কফিসপে বসে বসে  এক পরিচিতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আর আমরা এসেছিলাম একটু কফি স্ন্যাকস সহযোগে আড্ডা দিতে।  বসে থাকতে থাকতেই আলাপ। আর আলাপ পরিচয় হতেই ভটচায মশাইয়ের কথা উঠে এল। জানলাম উনি ভটচায মশাইয়ের সহপাঠী। 


             এরপর দু’একবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কিন্তু ওই শুভেচ্ছাবিনিময় পর্যন্তই।  শেষমেশ আবার দেখা হয়ে গেল অঘোরবাবুর মাসতুতো ভাইয়ের নাতনির জন্মদিনে। অঘোরবাবুর মাসতুতো ভাইকে নিশ্চয়ই আপনারা চেনেন, – সেই স্বনামধন্য তান্ত্রিক বগলা ভটচায। 


                    আজ বছরখানেক হল ভটচায মশাইয়ের ছেলে চাকরি সূত্রে কলকাতায়। ভটচায মশাই আর তার ছেলে স্বশরীরে এসে নিমন্ত্রণ করে গেছেন। অঘোরবাবু একে খাদ্যরসিক লোক তারপর আমাদের মতো দু’জন সঙ্গী, সুতরাং না যাওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই। বললেন, “বুঝলে সায়ক, শীতের রেশ এখনো কাটেনি, বেশ ভালই জমবে। বগলা যখন আছে মাটনের কমতি হবে না। ও যেমন খেতে ওস্তাদ তেমনি খাওয়াতেও। ” 


বিক্রম একখানা সায়েন্স জার্নাল নিয়ে মনযোগ সহকারে পড়ছিল, অঘোরবাবুর কথা শুনে জার্নালটা নামিয়ে রেখে বলল, “ভটচায মশাই তান্ত্রিক মানুষ, নরবলি টরবলি দেন কিনা কে জানে ! “


“কি বলতে চান মশাই ? বগলা কাপালিক নাকি ? আর দিলেও ওই….. ” অঘোরবাবু ওইখানেই আটকে যান। বিক্রম জার্নালটা তুলে নিয়ে মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলল, “আমি সম্ভাবনার কথা বলছি। সম্ভাবনা যে সবসময় সত্যি হবে তেমন কোনো মানে নেই। কি বল সায়ক ?”
বুঝলাম অঘোরবাবুর লেগপুল হচ্ছে। সুতরাং বিক্রমকে সাপোর্ট জানিয়ে বললাম,”সত্যি হলেও কি করার আছে।”


             অঘোরবাবু এতক্ষণে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। তিনি কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”ওকে, যাওয়া ক্যানসেল । নরমাংস হজম করার মতো হজমশক্তি আমার নেই মশাই।

বগলা চিরকালই একটু ভবঘুরে টাইপের, তাবলে ও যে নরমুণ্ডু শিকারী হয়ে উঠবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি মশাই। …. ক্যানসেল… ক্যানসেল….টোটাল ক্যানসেল… ..” বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলেন অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি আর বিক্রম হো হো করে হেসে উঠলাম। সেই হাসি যদি অঘোরবাবুর কানে যায় তবে আর রক্ষে নেই। 

জন্মদিনের দিন বিকেলে আমরা সবাই সাজগোজ করে তৈরি, অঘোরবাবুর কিন্তু দেখা নেই। অগত্যা গেলাম তার বাড়িতে । অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে রাজি করালাম। বিক্রম বলল, “মাংসটা বাদ দিয়ে বাকি পদগুলো খেলেই হলো। কেক মিষ্টি পায়েসে তো আর কোনও সমস্যা নেই।” 


               অঘোরবাবু রাজি হলেন। পার্টিতে এসে দেখলাম অঘোরবাবু সেদিন মিথ্যা বলেননি, এলাহি আয়োজন। স্টার্টার হতে শুরু করে আইসক্রিম পর্যন্ত সর্বত্রই খাদ্যরসিকের নিপুণ অভিজ্ঞতার ছাপ। জন্মদিনের পার্টিতে প্রফেসরকে দেখলাম।  একটা অরেঞ্জ জুসের গ্লাস হাতে করে একজনের সাথে গল্প করছে । আমাদের দেখে ভদ্রলোককে এক্সকিউজ জানিয়ে আমাদের দিকে ঘুরে বলল, “হাই সায়ক ! হাই বিক্রমবাবু ! আবার দেখা হয়ে গেল। তারপর কেমন চলছে বলুন। ” 


-“তাহলে ওরাই হাঁই তুলুক আমি যাই।” অঘোরবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন। “না বাঁড়ুজ্জেমশাই, আপনাকে কি ভুলতে পারি ! আপনি সবার আগে। হৃদয়ে।” হো হো করে হেসে উঠলেন প্রফেসর । এরপর দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন অঘোরবাবুর দিকে। চেপে ধরলেন অঘোরবাবুকে। হাতের গ্লাস হতে কিছুটা অরেঞ্জ জুস চলকে পড়ল অঘোরবাবুর শার্টে । শার্ট মুছতে মুছতে অঘোরবাবু বললেন, “আপনি রাখতেই পারেন কিন্তু আমার সে জো নেই।

এই অশীতিপর হৃদয়ে যেকোনো সময় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আর এতদিনে যখন শূন্য হৃদয়ে কেউ এল না তখন আপনার মতো পক্ককেশ বৃদ্ধকে হৃদয়ে রাখতে আমার পক্ষ হতে যথেষ্টই আপত্তি আছে। যাই একবার বগলাকে দেখে আসি আর ওর নাতনিকে আশীর্বাদও করে আসি। ”  অঘোরবাবু ভেতরে গেলেন।


কেক কাটা হয়ে গিয়েছে, খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে।  মাটনটা বেশ পছন্দ হয়েছে প্রফেসরের। মাটনের একটা নরম টুকরো কাঁটা চামচে গেঁথে যেই মুখে তুলতে যাবেন অমনি  কোথা হতে এসে গায়ের উপর উল্টে পড়লেন অঘোরবাবু । 


             অজ্ঞান হয়ে গেছেন। বিক্রম সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। মুখে চোখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হল। জ্ঞান ফিরতেই অঘোরবাবু বললেন, “ঘরের ভেতরে….. ডাকাত মশাই…. ডাকাত…” অঘোরবাবুর কথামতো ঘরের ভেতরে যেতেই দেখা গেল একটা লোককে, বেশ ভদ্রলোকসুলভ কাপড়চোপড় পরা, হাতে একখানা কিচেন নাইফ ।  বার্থডে গার্ল তিন্নির মেজো মামা, – অগ্নিমিত্র মৈত্র । ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, তারপর একটা বিশ্রী ব্যাপারে ফেঁসে গিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছেন।


বিক্রম আর প্রফেসর কাছে যেতেই লোকটা ছুরি উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, “কেউ কাছে কাছে আসবে না। আমি সবাইকে চিনি।  এক একটা মুখোশধারী সব।”বিক্রম দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরল। প্রফেসর বললেন , “উনাকে  উত্তেজিত করবেন না বিক্রমবাবু।  উনি মানসিকভাবে সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। আচ্ছা এখানে ডাক্তার কেউ আছেন ? “

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ডাক্তারও ছিলেন। তিনি পরীক্ষা নীরিক্ষা করলেন। একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বললেন, “আপাতত চিন্তার কিচ্ছু নেই। তবে ইনাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান। গতিক সুবিধার নয়। “এরপর আবার হইহুল্লোড় শুরু হল।

অঘোরবাবুকে দেখলাম মাংসের পাত্রের কাছে ঘোরাঘুরি করতে। প্লেট হাতে ওদিকে যাচ্ছেন আর কি যেন একটা ভেবে পিছিয়ে আসছেন। সাহস করে আমিই এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে অঘোরবাবু একমুখী হেসে বললেন,”সবাই খাচ্ছে।.. একি, তোমার প্লেটেও তো রয়েছে দেখছি। তাহলে নরমাংস নয়। কি বলো সায়ক। একটু নিই তাহলে।” 


আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বেশ কয়েক টুকরো মাংস প্লেটে তুলে নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেলেন ভদ্রলোক । আমি আবার ফিরে এলাম বিক্রমের কাছে। আমাকে দেখেই বিক্রম বলল,”চলো তিন্নির মায়ের সাথে একটু আলাপ করে নিই । “বিক্রম  আর আমি এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে নিজেই এগিয়ে এলেন ভদ্রমহিলা।

 “নমস্কার বিক্রমবাবু।” “নমস্কার মিসেস ভটচায ।” “এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে আপনাদের ঠিকমতো অভ্যর্থনা করতেই পারলাম না। খুবই খারাপ লাগছে আমার।” ভদ্রমহিলা ধীর গলায় কথাগুলো বললেন। 


 বিক্রম বলল, “এ নিয়ে আপনার দুঃখিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি হয়নি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আপনার ভাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।  আচ্ছা মিসেস ভটচায, একটা কথা বলুন তো, আপনার ভাইয়ের কি কোনও মেজর অপারেশন বা কোনও বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল ? “”না সেরকম তো কিছু আমার জানা নেই। কেন বলুন তো ? “


-” না এমনই জিজ্ঞাসা করলাম। ফিসফ্রাইটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। আমি আরেকটা নেবো”  ফিসফ্রাইয়ের পাত্রটার দিকে এগিয়ে যায় বিক্রম। অনিলিখা কিন্তু বিক্রমের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। হয়তো তিন্নির মাকে করা বিক্রমের বেয়াড়া প্রশ্নটার মানে খুঁজছে সে।(চলবে ) 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *