দ্বিতীয় অংশ

১৯৬২ সাল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আমি নরেন্দ্রপুর কলেজে অর্থনীতি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। স্বপন বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল আর ঠাকুর পুকুর কলেজ থেকে প্রি ইউনিভার্সিটি পাশ করে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়তে এসেছে। কপর্দক শূন্য একদম একা একজন। আমাদের অনার্স আলাদা হলেও পাস কোর্সে দুজনেরই ইতিহাস। তাই অনার্স ছাড়া ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস সবেতেই আমরা সহপাঠী।
এছাড়া ও আর আমি দুজনেই একইসঙ্গে দিনরাতের হোষ্টেল মেট। অর্থাৎ একই পরিবার ভুক্ত, খাওয়া দাওয়া ঘুম সবই একসাথে। যারা হোস্টেলে থাকে নি তারা বুঝবে না এই সুযোগ বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্কের নিবিড়তা কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়। আর যেহেতু প্রথমবর্ষের সবাই একই হোস্টেলে থাকি তাই ভোরে উঠে প্রার্থনা সভা খাবার ঘর কলেজ ফিরে এসে মাঠে বা ঘরে সর্বত্র একই সঙ্গে কাটে।
পড়াশুনা আড্ডা সবেতেই একজন আরেকজনের সাথী। স্বপন দৃষ্টি হারা দেখতে পায় না। তাই একা চলতে ফিরতে ওর অসুবিধে। আমাদের হাত ধরতে হয়। এ নেহাত হাত ধরা নয়, হৃদয় স্পর্শ করা। একজন বন্ধুকে আরেকজনের অনুভবে পাওয়া। ওকে নিয়ে চলাফেরা করে আমরা বুঝি চোখে না দেখলেও রোজের দিনযাপন ও অন্য সবকিছুতে স্বপন পিছিয়ে থাকে না বরং আমাদের থেকে এগিয়ে।
না দেখলেও কাউকে কখনও চিনতে অসুবিধে হয় না। শুধু গলার শব্দে নয় কারও চলন বলন পায়ের শব্দে ও কাউকে চিনে নিত। আমরা কে কেমন তা ওর তীব্র অনুভূতিতে ধরা পড়ত। তাই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ও নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারত।
স্বপন শিশুবেলা থেকেই পরিবার ছাড়া ছিল। যতদূর খবর ওর বাবার নাম নলিনী মোহন গুপ্ত আর মায়ের নাম শান্তিলতা গুপ্ত। ওর পরিবারের কথা আমরা তেমন কিছু জানি না। ওর এক ভাইও দৃষ্টিহীন। তার নাম জীবন।
নরেন্দ্রপুরে পড়ত, ভালো বাঁশি বাজাতো। দৃষ্টি হারা বলে শৈশবেই দৃষ্টিহীনদের স্কুলের আবাসনে বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে হয়। বলা চলে শৈশবেই এক অনাথ জীবনের শুরু। ও আঘাত পাবে ভেবে এ ব্যাপারে আমরা জানতে চাইতাম না। প্রশ্ন করতাম না। তবে বুঝতাম ওর জীবন পরিবার থেকে অনেক বেশি বন্ধু নির্ভর। ও আমাদের মত বাবা মায়ের স্নেহ যত্নে বড় হওয়ার সুযোগ পায় নি।
দৃষ্টিহীন হিসেবে ওর যন্ত্রণা ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মিটিয়ে দিয়েছে আর বাবা মায়ের অভাবের যন্ত্রণা পরবর্তীকালে বন্ধুবান্ধব ঘনিষ্ট পরিজন এবং বিবাহ পরবর্তীকালে স্ত্রী কন্যা মিটিয়েছে। ও ছিল সদাহাস্যমান সংযত অত্যন্ত পরিশীলিত এক ব্যক্তিত্ব যে তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা নিয়ে হায়ুতাশ করত না, অন্যকে বুঝতে দিত না। স্বাধীনভাবে নিজেকে গড়ে তোলার লড়াইটাই ছিল তখন ওর জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য।
কলেজে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যেই গায়ক হিসেবে ওর শিল্প প্রতিভা আমাদের কাছে পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত হতে থাকে। ওর কলেজে পড়াশুনার সঙ্গে গানের চর্চা নিজের মত করে কারও সাহায্য ছাড়াই চলতে থাকে। সেটার শুরু হয়েছিল বেহালার ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ার সুযোগের দৌলতে। সেটা ছিল হাতে খড়ি। আর নরেন্দ্রপুরে শুরু হয় উত্থান পর্ব। যদিও তখন গায়ক হওয়ার স্বপ্নটা তেমন ভাবে দানা বাঁধে নি।
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডার মজলিসে এই চর্চা চলে যেখানে বন্ধুরাই ওর শ্রোতা ওর গুণগ্রাহী। নিজের অজান্তেই শিল্পী হিসেবে ওর উত্থানের প্রাথমিক পর্যায় এটা। সেখানে কোন আনুষ্ঠানিক গান শিক্ষার সুযোগ ছিল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ও ওর গানের প্রতিভার গুণে সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল। মিশনে প্রার্থনা সভায় রোজকার গানে ওর ওপর নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়েছিল। বন্ধুদের মজলিসে গায়ক হিসেবে ও সকলের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। ওর গানের প্রতি আসক্তি আর প্রতিভা ওর জীবনের চলার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেও হয়ে ওঠে। সঙ্গে সহযোগী হয়ে ওঠে বন্ধুরা।
তার মধ্যে আমিও একজন। আবাসিক কালে বন্ধুরা আর তাদের আত্মীয় পরিজন হয়ে ওঠে ওর নিকটজন।ওর সাফল্যের পেছনে জানা অজানা কম জানা সবার অবদান মনে রাখার মত। শুধু সহপাঠীরা নয় ওর আগে পরের পড়ুয়ারা হয়ে ওঠে ওর সহযোগী বন্ধু। পরবর্তী জীবনে ওর স্ত্রী তপতী ওর যোগ্য সঙ্গিনী। তপতী প্রথমে প্রেসিডেন্সি পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। ওর এক মেয়ে তানিয়া। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথমে বেহালার বরিশায় ব্লাইন্ড স্কুলে পরে কলেজে পড়াকালীন নরেন্দ্রপুর ওর খাওয়া পড়া থাকায় সাহায্য করেছে। সরকারি অনুদান কাজে লেগেছে সন্দেহ নেই।
এবার আসা যাক ওর সঙ্গীত জগতে। সে সময়কালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগৎটা শান্তিনিকেতনভুক্ত বিশ্বভারতীর কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে তার নির্দেশিত আদলে তার নির্দিষ্ট ঘরানায় তৈরী করা সাম্রাজ্য ছিল। সেই আদলে গাওয়া রথী মহারথীদের দখলে ছিল। তাদের নিদৃষ্ট করে দেওয়া স্বরলিপি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাকরণকে অমোঘ বলে মনে করা হত। এর একটু এদিক ওদিক হলে তার মধ্যে নতুন ভাবনার মিশ্রণ ঘটলে তাকে ব্রাত্য বলে বিবেচনা করা হত। যে সেটা করার চেষ্টা করত সে ব্রাত্যজন বলে বিবেচিত হত। শ্রদ্ধে়য় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস নিজেকে সেই ব্রাত্যজন বলে মনে করতেন।
তাঁর গলায় রবীন্দ্র সংগীত ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত‘ বলে পরিচিতি পায়। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী আর অভিমানী যা এই নামের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজদরবার তখন বিশ্বভারতী। শ্রদ্ধে়য় শান্তিদেব ঘোষ, অরবিন্দ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গায়কগাইকারা পথপ্রদর্শক। অশোকতরু বন্দোপাধ্যায় সাগর সেনরা অপেক্ষমান তরুণ তুর্কি এই জগতে।
একা লড়াই করে দেবব্রত বিশ্বাস তিল তিল করে গড়ে তুলছেন রবীন্দ্র সংগীতের এক বিকল্প ঘরানা তাঁর ছোট্ট রাসবিহারী এভিনিউএর ঘরে। ব্রাত্যজন আর জনগণের কাছে ব্রাত্য থাকেন না। চলতি ঘরানার বিপরীতে নিজের ঘরানাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য একা এই অসম লড়াই লড়ছেন দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁর গলায় তাঁর গানের আদলটা একটা অন্য আবেদন রাখত যা আমজনতাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকে আকর্ষণ করত। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে রাজদরবার থেকে জনতার দরবারে নিয়ে আসার এ এক অসম প্রতিষ্ঠিত মতে বেআইনি লড়াই। গ্রহণ যোগ্যতার দিক থেকে ব্রাত্যজনের আবেদনটা ছিল মাটির অনেক কাছাকাছি। আর তা কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মৌলিকত্বকে অস্বীকার করেনি।
একটা সার্বজনীন আবেদন যোগ করেছে। তাই ব্রাত্যজনের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এককভাবে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন রবীন্দ্র সংগীতের জগতে এক ব্যতিক্রমী পাঠশালা। রবীন্দ্র সংগীতের ঘরানা দুভাবে ভাগ হতে থাকে। রবীন্দ্র সংগীতের ইতিহাসে আমাদের স্বপন ছিল দেবব্রত ঘরানার উপাসক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে যেন স্বপন গুপ্তের জন্যই মঞ্চ তৈরী হচ্ছিল যার কান্ডারী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস স্বয়ং। স্বপন রেডিওতে দেবব্রতের গান শুনে অদ্ভুত নৈপুণ্যতায় তুলত, কণ্ঠস্থ করত।
ও পড়তে পারত না। তখন ব্রেইলে পড়ার তেমন সুযোগ ছিল না। ওকে শুনে শুনে মুখস্ত করতে হত। তারপর আমাদের শোনাত। চাই বা না চাই স্বপন প্রথম থেকেই এ ব্রাত্য ঘরানার পূজারী। সেই অর্থে নিজেও সঙ্গীত জগতে একজন বিদ্রোহী। তখনও সে দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্র নয়, আনুষ্ঠানিক ভাবে তার সৈন্যবাহিনীর সৈনিক নয়। কিন্তু স্বপন নিজের অজান্তেই লড়াইটা শুরু করে দিয়েছে ।
একই সঙ্গে এটা তার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ। স্বপনের গলায় এই ঘরানার গান আমাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এই জন্যই যে এই ঘরানার জন্ম একটা বিদ্রোহের প্রসূতি সদনে। স্বপনকে বিভিন্ন গানের আসরে নিয়ে যাওয়া ওকে উৎসাহিত করার সৈনিক হয়ে উঠেছি আমরা। আমরা ওর শ্রোতা আবার আমাদের মাধ্যমে নতুন শ্রোতাদের আগমন, আমাদের হাত ধরে শহরে নগরে বন্দরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ওর প্রবেশ। নরেন্দ্রপুরে বিভিন্ন মফস্বলের ছেলেরা আসত যাদের হাত ধরে ওর গ্রাম বাংলার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়। আমার আর আমার মত কয়েকজনের হাত ধরে কলকাতা আর পার্শ্ববর্তি অঞ্চলে অলিতে গলিতে ওর ছোটখাট অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।
স্বপনকে নিয়ে আমাদের উন্মাদনার আরেকটা সামাজিক কারণ ছিল। সমাজে তখন ভাবনা চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটছে। দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন বামপন্থী ঘরানার মানুষ। গান নাটক চলচিত্র জগতে সলিল চৌধুরী বিজন ভট্টাচার্য্য ঋত্বিক ঘটকের বন্ধু ও সহযোগী। সেই ভাবনার আবেদন প্রতিফলিত হতো তার গানের নতুন ঘরানায় তার আবেদনে। সেটা আমাদের মত অল্প বয়েসিদের আকর্ষণ করত। দেবব্রত হয়ে ওঠেন গানের জগতের বিদ্রোহী ঘরানার কেন্দ্রবিন্দু। পরবর্তীকালে স্বপন দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে দীক্ষা নিয়ে হয়ে ওঠেন এই ঘরানার যোগ্য উত্তরসূরী।
পেশার জগতে যেমন বন্ধুত্ব থাকে তেমনি থাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর তার থেকে উদ্ভুত এক ধরনের দ্বেষ। আমরা যারা পরবর্তীকালে স্বপনের গানের জগতটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি তারা আঁচ করতে পারতাম এই দুই ঘরানার মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এমন কি গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে তার প্রতিফলন।
যাই হোক আমি আমার প্রতিবেদনে স্বপনের স্বপন গুপ্ত হয়ে ওঠার পেছনে বন্ধু নানা স্তরের শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতা যে কতটা গুরুত্বপুর্ন সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করব। স্বপনের এই উত্থান পর্ব শুরু হয়েছে ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে কলেজে পড়ার সময় কালে। গানের প্রতি আকর্ষণ আর গান শিল্পে তার দক্ষতা তার অনেকটা জন্মগত। তার এই উত্থানপর্ব শুরু হয়েছিল হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে মজলিসের মাধ্যমে।
তার টিকে থাকা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বা তার আগে বেহালার ব্লাইন্ড স্কুলের একটা আনুষ্ঠানিক ভূমিকা ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে উত্থান প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক এই পর্যায়ে কোন আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা সে পায়নি ১৯৬৫ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্র হওয়ার সুবিধা পাবার আগে পর্যন্ত। তার আগে কলেজে পড়ার সময় অবসরে নরেন্দ্রপুর হোস্টেলে ওখানকার মাঠে ওখান থেকে একরকম নিয়ম ভেঙে আবাসনের বাইরে কোন বাঁশ বনে বা বন্ধুদের বাড়িতে বসে গানের আড্ডা বসত স্বপনকে নিয়ে। ও গাইত আর আমরা শ্রোতা। আমরা পাড়ায় পাড়ায় কলকাতা বা মফস্বলে গ্রামে গঞ্জে ওকে ফাংশনে গান গাইতে নিয়ে যেতাম। ও ছিল বিনা পয়সার শিল্পী তখন।
আমার বাড়ি তখন প্রথমে কলকাতার বালিগঞ্জের কেয়াতলায় তারপর ত্রিকোণ পার্কের কাছে অশ্বিনী দত্ত রোডে। সে সুবাদে কলকাতায় আমার বাড়িতেই ওর ঠেক। ছুটিতে সুযোগ পেলেই আমার বাড়িতে থাকা খাওয়া। এছাড়া অন্য বন্ধুদের বাড়িতে যাতায়াত নানাভাবে তাদের সহযোগিতা। ও হয়ে যায় আমার বাড়ি সহ অন্যান্য কয়েকজন বন্ধুদের বাড়ির সদস্য। আশুতোষ কলেজে পড়ুয়া আমার বন্ধু ক্ষৌনীশ তপনেশ অরুণ হয়ে উঠেছিল স্বপনেরও বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার দাদা কাজল রায় ওর ঘনিষ্ট বন্ধু।
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নতুন বন্ধুরা একই ভাবে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। তখন ও হার্ডিঞ্জ হোস্টেলের বাসিন্দা। আমাদের হাত ধরে শহরের অলিগলি গ্রামে গঞ্জে মাঠে ঘাটে আঞ্চলিক গানের আসরে ওর উপস্থিতি। আমি ছাড়াও শিবপ্রসাদ বিজয় দেবপ্রসাদ উৎপল আরো অনেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাংশনে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। সেখানে সবার সহযোগিতায় ওর অবাধ প্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যে ও পিয়ান আকর্ডিয়াম বাজানো রপ্ত করে।
অদ্ভুত নৈপুণ্যে তা নিয়ে ওর দরাজ গলার গান। আবার দেবব্রত বিশ্বাসের ঘরানায় যার শ্রোতা তখন উপচে পড়ত। তখনও দেবব্রতের ছাত্র না হয়েও ও দেবব্রতের ঘরানার একনিষ্ঠ গায়ক বলে পরিচিত হতে থাকে। সেটা দেবব্রত বাবুও জানতেন বলে আমি বুঝি একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেটা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। ওর আনুষ্ঠানিকভাবে দেবব্রত বাবুর কাছে শিক্ষা গ্রহণের আগে আমার বাবার অনুমোদন নিয়ে আমি ওকে নিয়ে দেবব্রত বাবুর কাছে যাই উনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য আমার বাড়ির খুব কাছে উনার ত্রিকোণ পার্কের কাছে বাড়িতে। উনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু।
দেবব্রতবাবু খুব মেজাজি মানুষ। মেজাজ ভালো না থাকলে কাউকে পাত্তা দিতেন না আবার মেজাজ ভালো থাকলে তাকে নিয়ে বসে যেতেন আড্ডায়। আমি উনার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি ঠাট্টা করে বলেন, ‘ও স্বপন! যে আমার গলা কইরা গান গায়‘। আমি সেদিন ভয়ে আর কিছু বলার সুযোগ পাই না। বুঝি উনি স্বপনের কথা জানেন। তার কিছুদিন পরের কথা আজ সবার জানা। ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নরেন্দ্রপুরের কাছে জগদ্দলে কোন একটা গানের আসরে স্বপনের গান শুনে উনি তাকে ছাত্র বলে দীক্ষিত করেন। শুরু হয় স্বপনের পাহাড় শৃঙ্গ জয়ের যাত্রা। এই ব্রাত্যজনের সাহচর্যে। সে অনুষ্ঠানে বন্ধুরাই স্বপনকে গানের সুযোগ করে দেয়। আর সেখানেই উত্তরাধিকারী ছাত্র আর শিক্ষকের মহামিলন।
আর একটা ঘটনার উল্লেখ করি এই প্রসঙ্গে তখনকার গানের জগতের মহারথীদের মহান হৃদয় স্পর্শের কথা তুলে ধরতে। বালিগঞ্জে মতিলাল নেহেরু রোডের এক কানা গলিতে ছোট্ট অনুষ্ঠান কিন্তু মহান। কারণ হেমন্ত মুখার্জী গাইবেন। আয়োজকরা আমার বন্ধু পার্থ মিঠু মানব বিমলরা। স্বপন গাইবে। ওকে নিয়ে গেছি। হেমন্ত বাবু এসেছেন। আমি জানি হেমন্তবাবুর মত গায়কের গান আগে হয়ে গেলে স্বপনের গানের কদর আর থাকে না। আমি বন্ধুদের ওকে আগে সুযোগ দেওয়ার কথা বলব ভাবছি তখন হেমন্ত বাবু নিজেই উদ্যোক্তাদের ডেকে বলেন, ‘‘ আমার আগে ওই অন্ধ ছেলেটিকে বসান।‘
‘ উনার উদারতা আমাকে মুগ্ধ করে। এভাবে অঞ্চলে অঞ্চলে বন্ধুদের সহযোগিতায় গান গাওয়া ওকে গানের গলিপথ থেকে রাজপথে পৌঁছে দিতে সাহায্য করা। ওর দৌলতে আমার সৌভাগ্য যে আমি তখনকার গান ও শিল্প জগতের কোন কোন মহারথীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। যেমন দুর্গাপুরে স্বপনকে গানের অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে পূর্ণদাস বাউলকে পাশের ঘরেই দেখি। বা হিন্দুস্থান রোডে পাহাড়ি স্যান্যালের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পাই। আর হেমন্ত বাবুর কুঠা তো আগেই বললাম।
আমার মাধ্যমে স্বপনের পরিচয় হয় এমন কয়েকটা পরিবারের যারা স্বপনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে নানা ভাবে সাহায্য করে স্বপন যখন স্বপন গুপ্ত হয় নি সেই সময়কালে। যেমন আমার স্কুলের বন্ধু ক্ষৌনীশের দিদি, শান্তাদি আর জামাইবাবু প্রশান্তদা। প্রথমে উনাদের একডালিয়া প্লেসের বাড়িতে পরে লেক রোডের বাড়িতে। সেখানে গানের আসর বসত। উনার এক ছেলে তপন তখন ছোট, গান গাইতে সবে শুরু করেছে। আর ওর ভাই বিটু। তবলা বাজাতো। আজ তপন টিভি শিল্পী। তপন গুহ নামে পরিচিত আর বিটু তবলা বাজক প্রসেনজিৎ। এছাড়া কেয়াতলায় বাচ্চু নাগের বাড়িতে আড্ডা।
ওর বোন বেবী গান গাইত। স্বপন পরবর্তী কালে আমেরিকা গেলে বেবীর ওখানে উঠত। এছাড়া ছিল বর্তমানের নরওয়েবাসি নির্মল ব্রহ্মচারী যার উদ্যোগে স্বপন স্বপন গুপ্ত হয়ে ওঠার পর সেখানে গায়ক হিসেবে আমন্ত্রিত অতিথি। স্বপন তপতী দুজনেই ওদের বাড়িতে অতিথি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমাদের পরিচয়। এছাড়া দলমত নির্বিশেষে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য বন্ধুরা। মনে পড়ে নরেন্দ্রপুরের পর ওর সঙ্গে হারডিঞ্জ হোষ্টেল তারপর সাদার্নপার্ক রোডে অজয়ের বাড়ি।
অজয় নানা ভাবে সাহায্য করে। স্বপনকে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়। এর পর লেক গার্ডেনস আর সবশেষে মোমিনপুর তপতীর বাড়ি। এছাড়া ছিল মাই ক্লাব কফি হাউজের আড্ডা। স্বপন স্বপন গুপ্ত হয়ে ওঠার পর অর্থাৎ সত্তর দশকের শুরুতে, স্বপনের জীবনের মধ্যগগনে বছর কয়েকের জন্য ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমে যায় কারণ আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয় পথে পথে অন্য পথের খোঁজে।
স্বপনের দাঁড়ানোর পেছনে আমার জানাদের মধ্যে যাদের অবদান তাদের মধ্যে তুষারদা আর তার স্ত্রী দীপ্তিদি আর ওদের আত্মীয়া গায়িকা বন্দনা সিংহের ভূমিকা যথেষ্ট। বাটানগরে তুষারদার বাড়ি আর ভবানীপুরে উনাদের আত্মীয়ের বাড়ি স্বপনের গানের চর্চার জায়গা ছিল। এছাড়া ছিলেন ওর দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় সুশীল সেন আর তাঁর পরিবার। বিজয়গরের ওর আর এক সম্পর্কে আত্মীয় পরিবার যে বাড়ির এক মেয়ে আমাদের আর এক দৃষ্টিহীন বন্ধু দিলীপ কাওয়াসকে বিয়ে করে।
পড়ে দিল্লীতে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কলকাতায় ওদের বিজয়গরের বাড়িতে আমাদের আড্ডা ছিল। পরবর্তীতে স্বপনের খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা গুণীজন ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। আবার এরই মধ্যে কোন কোন মহল থেকে প্রতিবন্ধকতার পরিবেশ তৈরি হয়নি যে তা নয়। স্বপন এ সব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবলিলালায় পাহাড় শৃঙ্গে উঠেছে নিজের জয়ের পতাকা হাতে। বলতে দ্বিধা নেই সহযোগিতা এসেছে মত দল নির্বিশেষে সবার কাছ থেকে। তবে শেষ বিচারে বলতে হয় ওই নিজে নিজের স্রষ্টা।
ছোটবেলা থেকেই সে পরিবার হারা। অনাথ ব্রাত্য। সেখান থেকে বন্ধুদের সহযোগিতায় নিজের পথটা খুঁজে নিয়েছে। তারপর ‘ব্রাত্যজনের‘ দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তাঁর সহযোগিতায় হয়ে উঠেছে জনতার ঘরের আপনজন তার গানের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে। বন্ধুরা জীবনে চলার পথে সেতু বন্ধনে একটা একটা করে ইট গেঁথেছে।
মানসিকভাবে বামপন্থী ভাবনার প্রতি ওর আনুগত্য ছিল। আর এইজন্যই বোধহয় সংবাদ মাধ্যম ওর অসুস্থতা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় নি। টিভিতে ওর সংবাদ গুরুত্ব পায় নি। যেন ওরা খবরটা জানতই না। মৃত্যুর আগে দুমাস টাটা ক্যানসার হাসপতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের খবরটা আমজনতাকে জানাবার প্রয়োজন মনে করে নি। রাজ্য সরকার সামান্য সাহায্য করে দায় সেরেছে। মৃত্যুর পর খবরের কাগজে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়।
অথচ পেঁচা পেঁচির হাঁচি উঠলে খবরে হেড লাইন হয়। তাদের জন্য অবাধ সরকারি অনুদান নামজাদা নার্সিং হোম বা উডবার্নে বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা। যে সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ না শুনলে পিছিয়ে থাকতে হয় তারা বোধ হয় মনে করে স্বপনকে চিনলে পিছিয়ে থাকতে হয়। হায়রে সংবাদ মাধ্যমের শিল্প মনস্কতা! দলছুট নীতি হীনরাও নামকরা টিভিতে নামকরা বিরাট প্রচারপাত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা জানি স্বপন ছিল সত্তর দশক থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে রবীন্দ্রসংগীতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আজ আমার জীবন সায়াহ্নে স্বপনের সঙ্গে প্রায় ষাট বছরের বন্ধুত্ব আর ওর সান্নিধ্যে জমে ওঠা অসংখ্য টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে ওঠে। সেই স্মৃতির আলোতে তাকে আজও আমি বোঝার চেষ্টা করি। সে ছিল অসম্ভব ধীর স্থির প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন। আমরা একবার মুকুটমনিপুর বেড়াতে গেছি। ওর মেয়ে আমার ছেলে আর ওর স্ত্রী তপতী আমার স্ত্রী সাধনা। সাধনা আবার কিছুদিনের জন্য ওর গানের ছাত্রী। মুকুট মনিপুরে কংসাবতী নদীতে নৌকো বিহারে বেরিয়েছি। গান গল্প গুজবে আড্ডা চলছে।
ওদিকে আমার ছেলে ওর থেকে একটু বড় তানিয়ার পেছনে লেগে আছে। তানিয়া ভয়ে গুটিয়ে। হঠাৎ স্বপন বলে, ‘‘রণেশ, আমরা নিশ্চয় নদীর পাড় ঘেঁষে চলেছি‘‘। ও তো দেখতে পায় না বুঝলো কি করে? ওর কথায় আমার চোখ খুললো। দেখি নৌকো চলেছে নদী কিনারা ধরে। গাছের ছায়া এসে পড়েছে নৌকোতে। বুঝলাম এর ফলে যে শীতলতা তৈরী হয়েছে তার অনুভবে সে বুঝেছে নৌকোর এই শৈত্য। আমরা যেটা দেখেও দেখি না ও সেটা অনুভবে বোঝে। ও একই সঙ্গে ছিল খুব রসিক। টুকরো টুকরো চুটকিতে মাতিয়ে রাখত আড্ডা। কিন্তু অসম্ভব সংযত। বন্ধুদের মধ্যে আমাদের কথা বার্তা ছিল লাগামহীন। ভাষা স,র,ল,ব নানা বিশেষণে বিশেষিত।
কিন্তু ওর মুখে কোনদিন অসংযত কথা শুনিনি। অথচ বাবা মায়ের শাসনে ও বড় হয় নি। অনাথ আশ্রমের জীবন কেটেছে শৈশবে বাল্যে একান্ত অবহেলায়। ওর স্মৃতিশক্তি ছিল তুখোড়। তখনকার রেডিও শুনে একটার পর একটা গান মুখস্থ রাখত। সামনে খাতা রেখে গান গাওয়ার সুযোগ ওর ছিল না। সব বয়সের মানুষ ওর কাছে মুহুর্তের মধ্যে হয়ে উঠত আপন। আমার বাবা ছিলেন ভীষণ রাশভারী। অন্য বন্ধুরা ভয়ে গুটিয়ে থাকত। বাবার সঙ্গে দেখা হলেই স্বপন ওর চিরায়ত ভংগিতে বলত, ‘‘মেসোমশাই কেমন আছেন?‘‘ ঠিক যে ভংগিতে আমাদের ডাকে।
সব বয়সিদের সাথে সমান ভাবে মিশে যেতে পারত। যেমন আমার দাদা ওর বন্ধু হয়ে উঠেছিল তেমনি আমার ছোট ভাই বোনদের সঙ্গে ও ছিল সাবলীল। বাড়িতে এলে আমি থাকি বা না থাকি মায়ের কাছে থাকা খাওয়ায় ওর কোন অসুবিধে ছিল না। সব ধরনের মানুষের সঙ্গে ওর ছিল অবাধ মেলামেশা। কিন্তু ও তাও ছিল নিজেতে নিজে সম্পূর্ণ। প্রতিভার জোরে আর নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে গানের সঙ্গে পড়াশুনায়ও সার্থকতা পেয়েছে।
আজ স্বপন চলে গেল। আমরা যে কেবল একজন সংগীত শিল্পী হারালাম তা নয়। একজন অকৃত্রিম বন্ধু হারালাম যাকে নিয়ে জীবনটা ভরাট হয়ে থাকত। ওর জীবনে আমি যেমন ছিলাম ওর সাথী তেমনি আমার সুখ দুঃখ নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তার জীবনে ও ছিল আমার একান্ত সাথী। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শিবু, বিজয়, কালী, ইন্দ্রানী, অলোক, দেবপ্রসাদ, উৎপল, বিদ্যুৎ, প্রভাস আরও অসংখ্য আমার চেনা অচেনা বন্ধুরা ছিল ওর জীবনের অবিচ্ছেদ্য সাথী। ওর জীবন নৌকার হালের পানি।
তবু পাই তোমাকে
আর জন কোলাহলে পাবে না তাকে
প্রিয়জনের থেকে দূরে বহুদূরে
সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে
সে চলে গেছে আঁধারের নিরালায়
সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে একান্তে
প্রকৃতি মাঝে সে থাকে নিজ সত্ত্বায়
কখনও জঙ্গলে বিজনে
কখনও বা পাহাড়ের চূড়ায়
কোন সে অতলে একাকিত্বের নিঃসঙ্গতায়।
তবু তোমাকে পাই আমি প্রতি মুহূর্তে
দিনের আলোয় রাতের আঁধারে
গন্ধে স্পর্শে পাই তোমাকে
তোমাকে পাই হাসি কান্নায়
তোমাকে পাই ভালোবাসায়
মননে তোমাকে পাই পাই তোমাকে ভাবনায়।