আলোর পথে – কেয়া চক্রবর্তী

শিরোনাম : আলোর পথে
কলমে : কেয়া চক্রবর্তী

বেশ স্বচ্ছল একান্নবর্তী পরিবারেই জন্ম হয়েছিল অনন্যার।যৌথ পরিবারে সবার সাথে বাবা মায়ের আদরেই হচ্ছিল বড়, পড়াশোনাতেও ছিল খুবই ভালো। জেঠা, কাকু ও ঠাকুমার আদরে লালিত। যেহেতু একটিই মেয়ে সব ছেলেদের মাঝে তাই সবাই চোখে হারাতো। সব বায়নাই সবসময় পূরণ হয়ে যেত। হঠাৎই একদিন বাড়িতে এলো জেঠতুতো দাদার বন্ধু রজত। অনন্যার রজতের সঙ্গে হল প্রথম পরিচয়। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, ও কখন না জানি একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিলো ওরা। রজত ছিল ওদের পাল্টি ঘর, পড়াশোনায় তুখোড়। একটি বেসরকারি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে বেশ উচ্চপদে কর্মরত। মাস গেলে মোটা অঙ্কের মাহিনা, গাড়ি ,বাড়ি কোনোকিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু তাও যখন রজত অনন্যার বাবাকে তাদের সম্পর্কের কথা বলে বাবা ভীষণ রেগে যান। আর বলেন তোমার মত ছেলের সাথে বিয়ে দিলে আমার মেয়ে কষ্টই পাবে আজীবন।

মেয়েকে বলেন রজতের সাথে যেন কোনোদিন আর কোনো সম্পর্ক তুমি রেখো না, মা কষ্ট পাবে। বাড়িতে সবাই বোঝান, যে বাবার কথা মেনে চলো মা, নাহলে দুর্গতির সীমা থাকবে না। কিন্তু অনন্যা জিদ করতেই থাকে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি বেসামাল হতে থাকে। এদিকে অনন্যার বাবা পার্থবাবু ও কিছুতেই রাজি হয় না। শেষে বাবা দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মেয়ে তাঁকেই বেছে নেবে। তিনি আরো বলেন যদি অনন্যা তাঁর কথা না শোনে তবে তাঁর সাথে আর কোনো সম্পর্ক ও থাকবে না। কিন্তু মেয়ের কাছে তখন ভালোবাসার টান আত্মার টানের চেয়েও বড় মনে হয়। বাবাকে যদিও সে খুবই ভালোবাসে কিন্তু তখন এক পাগলামি ও তাকে ঘিরে ধরে, ও রজতের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেইভাবা সেই কাজ।কলেজ যাওয়ার নাম রজতের সাথে দেখা করে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেয়।

রাত হয়ে গেছে তবুও মেয়ে বাড়ি আসে না, সবাই চিন্তা করতে থাকে, এমন সময়ে অনন্যা রজতের সাথে উপস্থিত হয়, বাবা মায়ের আশীর্বাদ কামনা করে। কিন্তু বাবা তাকে বের হয়ে যেতে বলেন এবং আর যেন কোনোদিন এই বাড়ি মুখো না হয় সেই কথাও বলেন। মা লুকিয়ে কাঁদতে থাকেন মেয়ের এ হেন সর্বনাশ দেখে।

মেয়ে ও মা উভয়েই কাঁদতে থাকে। অনন্যা রজতের হাত ধরে পা বাড়ায় নতুন জীবনের পথে। রজতের বাড়িতেও এই বিয়েকে স্বীকৃতি দেয় না। তখন তাদের বন্ধু সুমনের বাড়ি আশ্রয় নেয়। পরেরদিন অফিসে গিয়েই ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই তারা নতুন ফ্ল্যাটে তাদের স্বপ্নের সংসারের রচনা করে। বেশ আনন্দেই তাদের দিন কাটছিলো। এইসময় অনন্যার হিয়া নামে এক বন্ধুর সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটি বেশ হাসিখুশি। কিছুদিন বাদেই অনন্যার হঠাৎ খুবই শরীর খারাপ হয়। কিছুতেই শরীর ভালো হয় না, অনেক ডাক্তার দেখানোর পর জানা যায় তার শরীরে কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে। যার জন্য কেমো নিতে লাগবে। রজত আর হিয়া সাহস দেয় ও তারা সবসময় তার পাশে আছে এই আশ্বাস দেয়। কেমো শুরু হতেই অনন্যার নানারকম সমস্যা দেখা দিতে থাকে, তার চেহারার সৌন্দর্য কমতে থাকে, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি করতে থাকে, কিছুই খেতে ভালো লাগে না।মাথার চুল উঠতে শুরু করে। প্রথম প্রথম রজত হাসি মুখে সব করলেও, ও তার সাথে হাসপাতালে যেতো, ইদানিং অফিসে মিটিং আছে ছুটি পাবে না এইসব বলে, কিন্তু অনন্যা সব বুঝতে পেরেও কিছু বলে না। যার হাত ধরে সে বেরিয়েছে তাকেই বিশ্বাস করে। রজত এখন মাসের বেশিরভাগ সময় ই ট্যুরে থাকে, অনন্যা একা থাকে বাড়িতে,দিন দিন অনন্যা কেমন শুকিয়ে যেতে থাকে, তার মন ভারাক্রান্ত হয়, এইভেবে যে সে রজতের ঠিক মতো খেয়াল রাখতে পারছে না, একদিন সে রজতকে ভাবে বলবে, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না।

আসতে আসতে অনন্যা ভালো হতে থাকে, ডাক্তার জানায় যে আর দুটো কেমো নিলেই সে সম্পূর্ণ সুস্হ হয়ে যাবে। হাসপাতাল থেকে কেমো নিয়ে বাড়ি এসে দেখে রজত ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে। অনন্যা বুঝতে পারে না, এইতো সবে আজ ই সে ট্যুর থেকে ফিরেছে, আবার কোথায় যাচ্ছে। তার শরীর খুবই খারাপ লাগছিল। অনন্যা জানতে চায় আবার ব্যাগ গোচাচ্ছো কেন? এই তো সবে ফিরলে? হ্যাঁ ঠিকই বলেছো, কিন্তু আমার জন্ম তো আর শুধু তোমার দেখাশোনা, আর তোমার ফাই ফরমাশ খাটার জন্য হয়নি। কি এমন বয়স আমার, আমার ও শখ শৌখিনতা আছে, তাই আমি ট্রান্সফার নিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমার চিকিৎসার সব টাকা আমি আগেই হাসপাতালে দিয়ে দিয়েছি, যাতে তোমার চিকিৎসা হতে পারে, আর তাছাড়া তোমার হাতে হয়তো সময় ও বিশেষ নেই, আমি কেন নিজের জীবন তোমার পিছনে নষ্ট করবো বলতে পারো? নিজের খেয়াল রেখো। এমন সময় হিয়া আসে। রজত বলতে থাকে, তোমায় বলা হয়নি, দেরাজে কিছু টাকা রেখে গেলাম, আর ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়েছি, কারণ আমি আমার নতুন জীবন হিয়ার সঙ্গে কাটাতে চাই। ওকে আমি বিয়ে করেছি। শুনে তো অনন্যার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, একে সে অসুস্থ, তাই এত বড় একটা ধাক্কা সে সামলাবে কিভাবে ভেবে পেলো না।তুমি তো বলেছিলে যে সারাজীবন আমরা এক সাথেই থাকবো, যে কোনো পড়িস্থিতিতেই, আর তুমি সবার আগে আমায় ছেড়ে চলে গেলে, কি অপরাধ আমার, আর একবার ভেবে দেখো, কিন্তু রজত সে কথায় কান দেয় না, আর গটগট করে হিয়ার হাত ধরে চলে যায়। অনন্যার দুচোখে অন্ধকার দেখে, তার বুকে অসম্ভব ব্যথা হতে থাকে, কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য সে আশেপাশে কাউকেই দেখতে পায় না। সে ভগবানকে বলে যে সে অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছে, বাবা মা এর কথা না শুনে, তাকে যেন ভগবান ক্ষমা করে দেন, ও এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বলে দেন।

এর পর আর কিছুই অনন্যা র মনে নেই, সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই সে দেখে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে, ভগবান তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন, বাবা ও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ডাক্তারের চিকিৎসায় এখন সে সম্পূর্ণ সুস্হ। তার শরীরে আর রোগের জীবাণু নেই, আজ সে রোগমুক্ত। তবে চেক আপ তাকে করাতেই হবে। আজ সে খুব খুশি, আবার এক নতুন জীবন পেয়ে, যেন তার শাপমুক্তি ঘটেছে।

একবছর হয়ে গেলো অনন্যা এখন সম্পূর্ণ সুস্হ। বাবার দেখা এক প্রতিষ্ঠিত পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। যে জীবন এতদিন রজতের সঙ্গে কাটিয়েছিল এই জীবন তার চেয়ে অনেকগুণ ভালো। অনন্যার নতুন স্বামী হিরণ বয়সে একটু বড় হলেও খুবই অমায়িক ও ভালো মনের মানুষ। আজ অনন্যার চেক আপের দিন। হিরণ গাড়িতে অপেক্ষা করছে, কারণ এই অতিমারীতে একজন ই মাত্র ডাক্তারের চেম্বারে যেতে পারবে, তাই অনন্যা একাই এসেছে ডাক্তারের কাছে, হঠাৎ কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে, পিছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়, আরে রজত না। একি চেহারা হয়েছে। আর ও এখানেই বা কেন ? সেটা অনন্যা বুঝতে পারে না। রজত নিজেই বলতে থাকে, তুমি আমার কাছে ফিরে এসো আমি ভালো নেই তোমায় ছাড়া। কেন হিয়া কোথায়? তখন রজত জানায় যে তাকে ছেড়ে যাওয়ার দুমাসের মাথায় ই তার ও কর্কট রোগ ধরা পড়ে, এই খবর পেয়েই হিয়া তাকে ছেড়ে চলে যায়। আজ সে সর্বস্বান্ত, চাকরি টাও নেই, কোনোরকমে চিকিৎসা করাচ্ছে, তুমি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অনন্যা র খুব কষ্ট হচ্ছিলো রজতের জন্য, কিন্তু সে শান্ত হয়ে জানায় তা আর সম্ভব না। রজত জানতে চায় কেন? তখন অনন্যা জানায় যে সে এখন অন্য একজনের স্ত্রী, আর মানুষটি বড় ভালো তার জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছে। তার দুঃসময়ে তিনি তার পাশে ছিলেন তাকে শত ঝড়, ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেছেন, আজ আমি ওনাকেই ভালোবাসি, তাই আমি কোনোভাবেই আর ফিরতে পারবো না, তবে হ্যাঁ তোমার চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেটা আমি ওনাকে বলবো, আর একটা চাকরি ও যেন উনি আপনাকে দেন তার ব্যবস্থা করতে বলবো, এর বেশি আমার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। ভালো থেকো, বলে অনন্যা এগিয়ে যায় তার নতুন জীবনে, নতুন পরিচিতি তার স্বামী হিরণের কাছে। রজত নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না, দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে, অঝোরে।

ভগবান বোধহয় এভাবেই নিঃশব্দে তাঁর বিচার করেন।

©কেয়া চক্রবর্তী®

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *