আত্ম আলো – পর্ব – ১০ – দেবদাস কুণ্ডু

‘এই তোমার ফোন।’ মালবিকার ডাকে ঘুম ভাঙে সীতাংশুর। সে বিছানায় বসে দেখে, সকাল ন টা বেজে গেছে। খুব দেরি হয়ে গেছে। হাউ টু এনজয়  দি সেলসম্যান – বইটি পড়তে পড়তে ভোর চারটে বেজে গিয়ে ছিল। বইটা পড়ে সে জানতে পেরেছে অনেক কিছু। একজন সেলসম্যানের কথা বলা, হাঁটা, পোষক, হাতের অবস্থান ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে তার সাফল্য। 

ফোনটা হাতে নিয়ে সীতাংশু বলে, ‘হ্যালো কে বলছেন?’ 

‘আমি প্রদীপ দেবনাথ বলছি স্যার’। 

‘বল।কি বলছিস। বাড়িতে আসেনি ক্লেম ফর্ম?’ 

‘হ্যাঁ ।এসেছে। হাসপাতাল কাগজের জন্য টাকা চাইছি’। 

‘কতো চাইছে?’ 

‘পাঁচশো টাকা।’ 

‘দিয়ে দে।’ 

‘আমি কেন দেবো’? আমার তো বাবা নয়। ‘

‘ আরে ছেলেদের বিয়ের পর দুটো বাবা হয়। একটা জন্মদাতা আর একটা শ্বশুর মশাই। 

‘ তা বলে পাঁচশো টাকা? ‘

‘ ওরা জানে ঐ কাগজ দিয়ে তুই লাখ লাখ টাকা পাবি। পাঁচশো দেবে না কেন? ‘

‘ কোন গ্যারান্টি আছে যে পাবো? ‘

‘ দেখ, এল আই সির ক্লেম রেশিও 99%’

টাকা তো আমি পাবো না। পাবে শাশুড়ি। ‘

‘ শাশুড়ির কোন ছেলে নেই। একটা মাত্র মেয়ে। সে তোর বউ। স্বামী মারা গেছে। দেখ, উনি কতো দিন বাঁচে? তারপর তো ফ্ল্যাট তোর হয়ে যাবে। যার বর্তমান ভ্যালু 40 লাখ। পাঁচশো টাকা খরচ করতে চাইছিস না? ‘

‘আমার কাছে পাঁচশো নেই।’ 

‘একটা এডজ্যাট করে কাগজ নিয়ে আয়। পেপার ছাড়া কিন্তু ক্লেম ফর্ম জমা করা যাবেনা’। 

 ‘ক্লেম পাবো তো?’ 

‘আবার প্রশ্ন। কতোবার এককথা বলবো?’ 

‘সীতাংশু ফোন কেটে দিল। 

   রোজ সকাল ছ টায় ওঠে শীতাংশু। বাথরুম সেরে কুড়ি মিনিট যোগাসন করে। সামান্য

‘ গরম জলে স্নান করে বসে রামকৃষ্ণর কাছে। ধ্যান করে পনের মিনিট। তারপর বড় গ্লাসে চিনি ছাড়া চা নিয়ে বসে। কাগজ পড়ে, চা খায়। সিগারেট টানে। এক সংগে তিনটে কাজ করে। মাঝ খানে গ্যাস্টিকের ব্যথার জন্য ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল। তখন কতো লোককে জ্ঞান 

দিয়েছে ধূমপান ছাড়ার জন্য। এখন তারা বলে কি হলো? দুদিনের মাস্টারি হয়ে গেল। ‘সেও মজা করে বলে,’ ক্যাজুয়াল  ছিল চাকরি টা। ‘নানা ব্যপারে টেনশন শুরু হতে ফিরে গেছে ধূমপানে। আসলে যা একবার জীবনের সংগে জরিয়ে যায়, তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা যায় না। পোষ মানা পায়রার মতো আবার চলে আসে। জীবনের বুঝি এটাই ধর্ম। এক প্রফেসরের কাছে সে কোচিং  পড়তে যেতো। দেখতো সব সময় ধূমপান করে চলেছে। সকাল থেকে রাত। সকালে একটা কাঠি ধরাতেন। আর কোন কাঠি নষ্ট না করে  সিগারেট শেষ হবার আগে ঐ সিগারেট থেকে নতুন সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে নিতেন। দিনে যে ক প্যাকেট লাগতো কে জানে। পরে সে জেনেছিল প্রফেসর ক্যান্সারে মারা গেছে। 

 শীতাংশুর মাঝে মধ্যে ভয় করে। শেষ পর্যন্ত তারও ক্যান্সার হবে না তো? । ইদানিং যে ভাবে বাড়ছে সিগারেটের সংখ্যা। পরে মূহুর্তে মনে হয় কেউ আমাকে গ্যারান্টি দিতে পারবে, যে ধূমপান ছেড়ে দিলে তার ক্যান্সার 

হবে না। কিংবা সে

আরো 20 বছর বেশি বাঁচবে।

        সীতাংশুর আজ মনে হচ্ছে, কেন প্রফেসর এতো সিগারেট খেতেন। পারিবারিক অশান্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। বাড়িও যেতেন না। কোচিংএ শুয়ে থাকতেন। আসলে মানুষ যখন বাঁচার জন্য হাতের কাছে কোন মানুষ পায় না, তখনই সে  বাঁচার জন্য, না মৃত্যুর জন্য নেশার দিকে এগিয়ে যায়? কে জানে? শীতাংশু অবাক হয়, এই মানুষই নাকি শ্রেষ্ঠ জীব! কতো কিছু আবিস্কার করেছে। আদিম সভ্যতা থেকে আধুনিক সভ্যতায় এসেছে। কিন্তু মানুষের মনের ভিতর সেই আদিমতা এখনও আছে। তা না হলে মানুষ কেন এতো হিংস? কেন এতো বর্বর? কেন এতো নিষ্ঠুর? পৃথিবীতে কেন এতো রক্তপাত? । কেন অদ্ধেক মানুষ না খেয়ে দিন কাটায়? কেন এখনও অনেক মানুষ শিক্ষা পায়নি? কেন শিশু শ্রমিক? হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল তার।প্রকাশ্য রাস্তায় এক কালো মানুষের গলায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক শেতাঙ্গ পুলিশ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কালো মানুষটির। কিন্তু মুক্তি দিল হত্যা করে। শুধু আসুরিক এক হাঁটুর চাপে। 

       শীতাংশু তার 50 বছরের জীবনে দেখলো, মানুষ একদিকে শ্রেষ্ঠ আবার অন্য দিকে বড্ড অসহায়। পুরানো বাড়ির ধসে পড়া, ঝুলে থাকা

বিপন্ন ছাদের মতো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *