আত্ম আলো – পর্ব- আট – দেবদাস কুন্ডু

ফোনটা বেজে উঠলো। সীতাংশুর হালকা ঘুম। চটকে গেল। উঠে বসলো বিছানায়। ফোন হাতে নিল। অচেনা নাম্বার। মধুমিতা কি? বুকের ভিতর এক অদম্য নেশার মতো চোরা উঞ স্রোত বইতে শুরু করলো।

         ‘

হ্যালো শুনতে পারছো? ‘

‘মধুমিতা তো?’

‘চিনতে পেরেছো?’

‘যার প্রতীক্ষা করে মানুষ, তার গলার স্বর রেকর্ড হয়ে যায় বুকে।’

‘তাই বুঝি? তুমি তো দারুন কথা বলতে পারো। কবিতা টবিতা লেখো নাকি?’

‘লিখি না। পড়ি।’ ‘

‘ কার কবিতা পড়ো, শুনি। ‘

‘ তুমি নাম বললে চিনতে পারবে? তুমিও কি কবিতা পড়ো নাকি? ‘

‘তুমি বলো না নাম’।

‘সুনীল, শক্তি, জয়, ভাস্কর’।

‘সুনীলের কেউ কথা রাখেনি, শক্তির যেতে পারি কেন যাবো, জয়ের পাগলি তোর সংগে।’ 

‘কি বলছো তুমি! তুমি এদের কবিতা পড়েছো নাকি?’ 

‘এক সময় খুব পড়তাম।’ 

‘তারপর? 

‘ থাক সে ইতিহাস।’ 

‘বলো, আমি শুনবো’। 

‘খুব পুরোনা আর জীর্ন ইতিহাস।’ 

‘তবু আমি শুনবো।’ 

‘তোমার পাশে তোমার বউ নেই?’ 

‘না। সে পাশের ঘরে শোয়’। 

‘কেন? তোমার সংগে ভাব নেই বুঝি? ‘ 

‘ভাব ছিল। একদিন ওর পাখা গজালো। উড়ে গেল।’ 

‘ভালোবাসা?’ 

   এইবার শীতাংশু কিছুটা সময় নিলো। তার কেন যেন মনে হলো, ভালোবাসা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। যাকে আমরা ভালোবাসা বলি, তা এক রকম মোহ। মোহের কাজ, কোন একটা নারীর প্রতি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আকর্ষন ধরে রাখবে। তারপর আসবে বিরক্তি। জীবনে যে ঐ নারীকে একটা সময় ভালো লাগতো, এটা বিশ্বাস করা তখন কঠিন হয়ে ওঠে। 

‘কি হলো ভালোবাসা কথায় চুপ হয়ে গেলে কেন?’ 

‘ভালোবাসা তো মানুষকে নীরব করে দেয়। তুমি যে একটা মিথ্যে নিয়ে খেলছো, তাতেই ডুবে থাকো। নীরবতা ভাঙলে সত্যটা যে বেরিয়ে আসবে।’ 

‘তুমি কি বললে, আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছে ভালোবাসার কথা বলা আমার ভুল হয়েছে। ‘

‘ তুমি যৌবনে কবিতা লিখতে মধুমিতা? ‘

‘ লিখতাম।তারপর দেখলাম, চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ‘

‘ সুকান্ত ‘। 

‘ আচ্ছা তুমি সুকান্তর সিঁডি কবিতাটা পড়েছো? ‘

‘ পড়েছি।বড্ড স্লোগান, স্লোগান মনে হয়েছে। ‘

‘ মানে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। ” 

‘তুমি হাসছো কেন মধুমিতা?’ 

‘বললাম না, ইতিহাস খুব পুরোনো। একটা সময় মনে হতো, জীবন জ্যোৎস্না মাখা নদীর চর।’ 

‘এখন কি মনে হয় তোমার?’ 

‘এখন! এখন কিছুই মনে হয় না।’ 

‘কিছু তো একটা মনে হয়। সেটা বলো’ ।

‘ জীবন আসলে একটা শূন্য! ‘

‘ তুমি হাসছো! তুমি জানো তুমি কতো বড়ো কথা বললে? আবার হাসছো? ‘

‘কাঁদতে যে পারি না। তখন মনে হয়, আমি হেরে গেলাম।’ 

অনেকটা সময় ফোনের ওপ্রান্ত চুপ। সীতাংশুর মুখে কোন শব্দ আসছে না। তারপর একটু অভিমানী গলায় মধুমিতা বলে,’ তোমায় না বলেছিলাম আসতে। ‘গত পরশু তোমায় ফোন করেছিলাম।’ 

‘আমায়! কই! নাতো! কোন মিস কল নেই। আমি তো তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।’ 

‘তোমাকে অপেক্ষায় বসে থাকতে বলিনি। আসতে বলেছিলাম। তার কি হলো? ‘

‘ সত্যি তো কি হলো? কেন আমি গেলাম না মধুমিতা? ‘

‘  এর জবাব আমি কি করে দেবো?’ 

‘আসলে কি হয়েছে বলো তো, আমার বুকের ভিতর একজন বলছিল, যা। আর অন্যজন বলছিল, যাবি না। আমি দ্বন্দে পড়েগিয়েছিলাম।’

‘জীবন তো দ্বন্দ্ব। ‘

‘কি করি বলত’?’ 

‘ কি আবার করবে? যেদিন মন চাইবে, চলে আসবে। একটা ফোন করো।আচ্ছা, তোমায় ফোন করতে হবে না। তুমি এসো। ‘

‘ আচ্ছা মধুমিতা তুমি তো এতো গল্প করলে আমার সংগে, কই একবারও তো আমার নাম জানতে চাইলে না। কেন? ‘

‘ নাম! আমি তো নামে বিশ্বাস করি না। মানুষে

 বিশ্বাস করি।’ 

‘আমি যেদিন তোমার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো, কি করে চিনবে তুমি? ‘

‘ আমি ঠিক চিনে নেবো। তুমি শীতাংশু।’

    দরাম করে একটা শব্দ হলো। সীতাংশু ধরফর করে উঠে বসল বিছানায়। আলো জ্বালাল।ঘড়িতে তিনটে দশ।এতো ক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল! এ ও বোধ হয় বাথরুমে গেল। দরজাটা আপনে থেকে বন্ধ হয়ে যায়, দরাম শব্দে করে। 

      এতো সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল! ‘ , আরে স্বপ্ন তো ভাঙবেই। স্বপ্ন কখনো গোটা থাকে নাকি?’ কে বললো কথাটা? সেই তোমার ভিতর বাস করে কয় জনা!

   শীতাংশু বাইরের দিকে তাকালো। নিস্তব্ধ কালো রাত আদিম গুহার নিকষ অন্ধকার নিয়ে শুয়ে আছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *