আত্মপরিক্রমার মধ্যে দিয়েই ব্রহ্ম পরিক্রমা – তৈমুর খান

 আশির দশকে বাংলা কবিতাকে যিনি আত্মজীবনীর ভাষা করে তুলেছিলেন সেই নিরীহ নিভৃতচারী কবি চিরপ্রশান্ত বাগচী। দীর্ঘদিন কবিতার পথে থাকলেও সর্বদা নিজেকে আড়াল করে গেছেন, সর্বদা লেখা প্রকাশেরও কোনও আগ্রহ দেখাননি। তবু কবিতায় শব্দ যোজনা-ই ছিল তাঁর মোক্ষম ও প্রধান অস্ত্র। তাঁর প্রাণাবেগ, আত্মোন্মোচন কতটা তীব্র ছিল তার কিছুটা আঁচ করতে পারি সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি কাব্যে।

 ‘আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরী’(প্রথম প্রকাশ রবীন্দ্রপ্রয়াণ বার্ষিকী ১৪২৮) এবং ‘জন্ম-জন্মান্তরের কথা’(প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০২১) কাব্য দুটিতে। 

     তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে সর্বদাই রায়না মারিয়া রিলকের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়:

‘The only journey is the journey within’

 অর্থাৎ একমাত্র যাত্রা হল ভেতরের যাত্রা। ভেতরের যাত্রার উপলব্ধি প্রতিটি কবিতাতেই ছায়াপাত ঘটিয়েছে। ‘আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরী’ কাব্যে তিনি বলেছেন: 

“রাতের অন্ধকারে আমি সেই গুপ্ত গহ্বরে ঢুকে সানন্দে সম্পূর্ণ  ভস্মীভূত।”

 অথবা,

“গভীরতর প্রদেশে গেলেই অনুভব করতাম মধুর-গোপন কণ্ঠ, হৃৎস্পন্দন আর সুন্দর অতীতের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সহসা মূর্ত… শীর্ষদেশে সেইসব আলোড়িত করছে আমার ভুল পথ-পরিক্রমা।”

 এই ‘ভুল পথ-পরিক্রমা’ যে একান্ত নিজের মধ্যেই ঘটে চলেছে নিরন্তর এবং তার ভাঙচুর, স্তব্ধতা, অনুশোচনা, শূন্যতার বিভিন্ন পর্যায় দেখা দিয়েছে—কবি সেইসব বোধ থেকেই কবিতায় চয়ন করেছেন তাঁর অন্তর্মুখী ভাষা। স্বাভাবিকভাবেই কবিতাগুলি আত্ম-আবিষ্কারের নিদর্শনও হয়ে উঠেছে। মার্কিনী লেখিকা গ্রেস লিকটেনস্টাইন বলেছেন:”Self-discovery is the secret ingredient that fuels  daring”—(Grace Lichtctenstein)

অর্থাৎ আত্ম-আবিষ্কার হল গোপন উপাদান যা সাহস যোগায়।এই আত্ম-আবিষ্কার তাঁর শব্দে ও শিল্পে বারবার বেজে উঠেছে। ‘জন্ম-জন্মান্তরের কথা’ কাব্যে লিখেছেন:

 “মুহূর্তে ঘন অন্ধকারের আগে আঁকা হয়ে গেল শেষ চিত্রকল্প: প্রত্ন মাটি-জল, ঘন শ্যাওলার ভিতর উত্থিত হল, মৃত সব জলজ প্রাণের ঘ্রাণ। পটভূমি বদলে যেতে পারে, তবু আমি এই সবই ছবি আঁকি রোজ

 আর দেখতে পাই, নিজের ভিতরে দম দেওয়া অনাদি ঘড়ি লীন হয়ে আছে রক্তে, হাড়মাংসে।”

    নিজের ভেতরের দম দেওয়া ঘড়িটিই কবির জীবনের আয়ু জানান দেয়। জন্মান্তর পাক খেতে খেতে আত্মপরিক্রমা করে। আর এই ‘আত্ম’ পুনরাবিষ্কার হয়, আদি জীবনের প্রজ্ঞা থেকেই তার রহস্যময় যাত্রা চলতে থাকে।

       আত্ম-পরিক্রমায় তাই স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বাস নেই। কোনও নীরব সংলাপে আত্মরতিকে চালনা করা; আত্মক্ষরণে অনুভূতির বিভাজিকায় গড়িয়ে যাওয়া; ব্রহ্মচেতনায় নিজেকে উৎসর্গ করা; নশ্বর প্রেমের কাছে নতজানু হয়েও অবিনশ্বরের দরজা খুঁজে ফেরা। তবু কোথাও উচ্ছ্বাস নেই। নিরবচ্ছিন্ন পার্থিব প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় মগ্ন থাকা। কবি বলেছেন: ‘নিজের ভিতরে নিজেরই শবদেহ দীর্ঘ ঘুমে আচ্ছন্ন।’

 ‘আমি’ সত্তাকে ‘তুমি’ সত্তার কাছে নিয়ে গিয়ে ‘আমি’ সত্তার অভিমানকে ‘তুমি’ সত্তার উদাসীনতায় মিলিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন। দুই সত্তা দুই বিপরীতমুখী অবগাহনে চৈতন্যের দুই প্রান্তে পরিভ্রমণ করেও শেষপর্যন্ত ব্রহ্ম সত্তায় ফিরে এসেছে। কবি লিখেছেন:

 “প্রতিদিনই প্রায় এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল জুড়ে তোমাকে চিত্রিত করেছি আমি অ; কখনও সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধু রাতের নৈঃশব্দ্য অনুভব করেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। বোঝনি। প্রয়োজন ছিল না আদৌ। বিশ্বাস আর বিশ্বাসহন্তার টানা-পোড়েনে তুমি কখনও শূন্যে, কখনও চোখ মেলেছ মাটির দিকে। আর বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে নিজের কাছে নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর।”

   এই প্রতিধ্বনি তো আত্মধ্বনিরই প্রজ্ঞা– আত্মরতির প্রতিবিম্বিত অনুজ্ঞা। একে কবিতার ভাষা দিতে গিয়ে কবির মনে হয়েছে:

 সেসব উন্মাদের অর্থহীন লিপি ছাড়া কিছু নয়। এখন বুঝতে পারি, সম্মোহনী শক্তির জন্য গাঢ় অনুশীলন প্রয়োজন কিংবা তা-ও যথেষ্ট নয়।”

 আসলে নিজেকে নিজে যেমন ধরা যায় না, তেমনি নিজেকে নিজে সম্মোহিতও করা যায় না। আত্মরতি সাময়িকভাবে আত্মসম্মোহনের বাতাবরণ তৈরি করতে পারে, কিন্তু তা কখনোই শাশ্বত কালের জন্য নয়। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় বিষণ্নতার অন্ধকার উপভোগ করেই নিজেকে নানা ক্রিয়ায় ঠেলে দিয়েছেন। কখনও সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটিয়েছেন, কখনও আত্মবিসর্জনের কথা ভেবেছেন—সে-ও  ব্রহ্মে বিলীন হওয়ারই আকাঙ্ক্ষা। পার্থিব জলকণা, কাদামাটির ঘ্রাণ বয়ে মহাকালের সমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। আত্মসংলাপে বহু অনুক্ত সংলাপও আত্মধ্বংস থেকে বেরিয়ে এসেছে। তখন আত্মযাপনের ঘোর আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। চেতনাপ্রবাহ তীব্র গতিময়তায় অবিচ্ছিন্ন আদি প্রজ্ঞাকেই ধারণ করেছে। এই আত্মসংলাপে কোনও অলংকারের আড়াল আসেনি। ছন্দের ধ্বনিঝংকারেও তা ঢাকা পড়ে যায়নি। গদ্যের চালে সাবলীল ভাষায় দ্বিমুখী প্রসারণ নৈঃশাব্দ্যিক সৌন্দর্যে সঞ্চারিত হয়েছে। আর এই নৈঃশাব্দ্যিকই ব্রহ্ম সমীপে পৌঁছতে পারে:

 “অপরূপ একটি আখ্যান রচনাকল্পে তখন শূন্য থেকে অভিধান হাতে নিয়ে বর্ণানুক্রমিক এমনই একটি শব্দ খুঁজছি; যা সত্যি সত্যিই ব্রহ্ম হতে পারে।”

   এই শব্দ নিরাভরণ, শূন্য নির্মাণের চক্রে সর্বদা এম্পটিনেস্ স্পেস সৃষ্টি করেছে বলেই কবি লিখতে পেরেছেন:

 “কীভাবে কখন যেন আমি শূন্যে শূন্যে নির্মাণ করে ফেলেছি অপার্থিব হাজার শিশমহল। তারপর থেকে প্রতিদিন আমি সেখানেই পৌঁছে যাই।”

 আত্মসত্তার নির্মাণে যে ব্রহ্মসত্তারই প্রতিফলন এই শূন্যতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমেরিকান মনস্তাত্ত্বিক লেখক ওয়েন ডায়ার(১৯৪০-২০১৫) বলেছেন:

“Everything that’s created comes out of silence. Your thoughts emerge from the nothingness of silence. Your words come out of this void. Your very essence emerged from emptiness. All creativity requires some stillness.”

(Wayne Dyer)

     অর্থাৎ যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তা নীরবতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আপনার চিন্তা নীরবতা থেকেই উদ্ভূত।আপনার কথা এই শূন্যতা থেকেই বেরিয়ে আসে। শূন্যতা থেকেই আপনার প্রাণসত্তা ফুটে উঠেছে। সমস্ত সৃজনশীলতার জন্য কিছু স্থিরতা প্রয়োজন। এই শূন্যতাতেই কবিও বিলীন হতে চান। তাঁর সমস্ত সৃজন ক্ষমতাকে স্থির করেন মগজের ভিতরে, আবার তা মগজ থেকে বের করে দেন শূন্যের ভিতরে। এভাবেই তাঁর শূন্যযাপনের ব্যাপ্তি বহুদূর বিস্তৃত হয়। ওয়েন ডায়ারের মতোই তাঁরও উপলব্ধি:

 “শুধু শূন্য আকাশ মাঠ নদী নৌকা শস্যক্ষেত কিংবা কোনও অন্ধকারে কয়েকটি দিনের জন্য রচিত হয়েছিল আমাদের জন্ম-মৃত্যুর বাসর; অপরূপ। তারপর হয়তো-বা আমরাই কোনও ভুলে, শূন্যের আবরণ ছিঁড়ে ফিরে পেয়েছি প্রকৃতির বর্ণবিভা;” সুতরাং চিরন্তন উৎস যা ব্রহ্মজীবনের ধারক—সেই মহাশূন্যতার নিকটেই জীবনের রূপ ও রূপান্তরকে আদি-অন্তহীন প্রজ্ঞায় কাব্যে লিখতে চেয়েছেন। ‘আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরী’ কাব্যের শেষ অংশে এই স্বীকারোক্তিই ফিরে এসেছে:

 “….ঠিক এমনই মুখ দেখলেই অপার্থিব একটা জলোচ্ছ্বাস; অনাদিঅনন্ত; আমি অনুভব করি, দেখতে থাকি আর নিজেই নিজেকে খুঁজতে থাকি স্থাবর ও জঙ্গমে…..”

  এই মানবমুখ, এই মানবজন্ম ব্রহ্মমুখেই এবং ব্রহ্মজন্মেই মিশে গেছে।

     ‘জন্ম-জন্মান্তরের কথা’ কাব্যটিতেও আত্ম-আবিষ্কারের অন্বেষাগুলিই তাৎপর্যময় কৌতূহলকে ধারণ করে অগ্রসর হয়েছে। পার্থিব জীবনকে ‘মোহমায়ার পরবাস’ বলেই মনে হয়েছে। তাই সেখানে সর্বদা ‘বিষামৃত’। হাজার হাজার প্রশ্নে নিজেকে বিদ্ধ করার মুহূর্ত খাড়া হয়েছে। প্রতিনিয়তই কবি সম্মোহন দৃশ্য ভেদ করতে চেয়েছেন। তাই পার্থিব আসক্তি ছিন্ন করার সাধনায় নিবিষ্ট হয়েছেন। বোধের বিস্তার ঘটেছে মূলত এই কাব্য থেকেই। তাই গাছের সঙ্গে নিজ সত্তার অভিন্নতা খুঁজে পেয়েছেন। আকাশের নীলে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন। আলোছায়ার আশ্চর্য কারুশালায় রক্তের বিশৃঙ্খলাকে এবং প্রবৃত্তির উন্মাদনাকে শিক্ষা দিয়েছেন স্বগত সংলাপ যা মৃত্যু চর্চারই প্রস্তুতি। প্রত্নদৃশ্যে বিভোর হয়েছেন। বৈচিত্র্যময় শব্দযাপনকে ব্রহ্মযাপনের ক্রিয়া হিসেবেই এই কাব্যে তুলে এনেছেন। কাব্যের শেষ পর্যায়ে এসে তাই বলেছেন:

 “সূর্য নিভে গেলেও সময় থেকে যাবে; তবে তা কোনওভাবেই পরিমাপযোগ্য নয়। শুধু এক আশ্চর্য অন্ধকার। অথবা তারও অধিক এই পৃথিবী তখন পুনরাবৃত্তির ইতিহাস।”

 এখানেই আমরা জন্মান্তরের আশ্চর্য ক্রিয়াটিকে সক্রিয় হতে দেখি। ব্রহ্ম সময়কে কখনোই পরিমাপ করা যায় না। তেমনি জন্মকেও জন্মান্তরে ঘুরপাক খেতে হয়। আদি-অন্তহীন এই জীবনচক্র, এই সময়চক্র, এই পৃথিবীচক্র; আর সব চক্রের মধ্যেই আছে এম্পটিনেস্-এর এক বৃহৎ স্পেস। এই স্পেসটিতেই কবি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

 চৌষট্টি পৃষ্ঠার দুটি কাব্যই বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

১)আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরী: চিরপ্রশান্ত বাগচী, চক্রবর্তী এন্ড সন্স পাবলিকেশন, বারুইপুর, মূল্য: ১২৫ টাকা।

 প্রচ্ছদ: ভগীরথ সরদার

২) জন্ম-জন্মান্তরের কথা: চিরপ্রশান্ত বাগচী, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড,৮/৩ চিন্তামণি দাস লেন, কলকাতা-৭০০০০৯, মূল্য-১০০ টাকা, প্রচ্ছদ:সুমন কবিরাজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *