#আজি_বসন্তে (পর্ব ৮)
#সুব্রত_মজুমদার
গল্প শুনে হেসে লুটিয়ে পড়ল তনিমা। ঠাকরুনের অবস্থাও তাই। হাসতে হাসতে ঠাকরুন বললেন, “আমার ওই গাঁয়েই বাড়ি মা, বিলাসীর শ্বশুরকে আমি দেখেছি। খুব ভালো লোক ছিলেন তিনি।”
হঠাৎই বিলাসীর নজর পড়ল তিনকড়ির উপর। চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “ওরে বুড়ো ড্যাকরা, তু বসে বসে কি শুনছিস ? মেয়েছেলেদের মাঝে তুর কাজ কি ?”
তিনকড়ি দাঁত বের করে হেসে বলল, “তাতে কি, এ বয়সে সব একাকার হয়ে গেছে। মেয়েই বল আর ছেলেই বল, তোমরা যা বলবে আমি তাই।”
-“তাই ?” উঠে এসে তিনকড়ির মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল তনিমা। বুড়ো সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে হাসল। তনিমা তখন বুড়োর একটা হাত ধরে টেনে বলল,”চল তাহলে। বিলাসী মাসি এস তো।”
কিসের লোভে জানি না মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো তনিমার সঙ্গে চলল বুড়ো তিনকড়ি। গাছ তলায় একটা জায়গায় ওকে বসিয়ে চোখ বুজতে বলল তনিমা। এরপর তিনকড়ির মুখের উপর বহুক্ষন হাত বোলাল সে। মুখে সুড়সুড়িও দিল। বুড়ো তো আনন্দে বিহ্বল। চোখ বুজে বসে রইল আকাঙ্খিত কিছু হওয়ার আশায়।
না বুড়োর ইচ্ছা পূরণ হল না। চোখ খুলতে বলল তনিমা। এরপর আদুরে গলায় বলল, “এখন যাও আমার জান, পরে কথা হবে। বাই।”
অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে ফিরে গেল তিনকড়ি। কিন্তু এ কি ! সবাই ওকে দেখে হাসছে কেন। বিরক্ত হয়ে নিজের মনেই বললেন, “দিনদিন পাগল হয়ে যাচ্ছে সব। ওই মোবাইল না কি যেন, ওতেই মাথা খেয়েছে।”
রান্নার ওখানে দেখা হল মাধব বাবুর সঙ্গে। তিনকড়িকে দেখেই মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলেন তিনি। তিনকড়ি রাগকষায়িত চোখে তাকাতেই মাধববাবু বললেন, “না না ঠিক আছে। জীবনের কোনও সাধ অপূর্ণ রাখতে নেই। আর ক’দিনই বা বাঁচবেন। ”
তিনকড়ি মুখ বিকৃত করে বলল,”রাস্কেল….! ”
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল জগাই, তিনকড়িকে দেখে পাগলাটে হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সে। এসেই দু'হাত দিয়ে চেপে ধরল তিনকড়িকে। তারপর অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, "আমার গার্লফ্রেন্ডের চেয়েও সুন্দরী আপনি। উইল ইউ মেরি মি ?"
একঝটকায় জগাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনকড়ি বললেন, “পাগলা কোথাকার….”
জগাই ছাড়বার বান্দা নয়। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হাত জোড় করে আবার বলল, “উইল ইউ মেরি মি ?”
আশেপাশের অনেকেই দূর হতে দেখছিল। এতক্ষণে কাছে চলে এসেছে তারা। বাঁদরনাচ দেখার জন্য যেমন ভিড় হয় তেমনি জটলা তৈরি হয়েছে। উৎসাহী দর্শকরা উৎসাহ দিয়ে বলল,"হ্যাঁ বলে দিন দাদু... হ্যাঁ বলে দিন।"
রাগে ফুঁসছে তিনকড়ি। সে তার অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে চুলের মুঠি ধরল জগাইয়ের। পিঠে দমাদ্দম কিল মারতে মারতে বলল, “পাগলামি পেয়েছিস ! আমার সাথে পাগলামি ! মেরেই ফেলব তোকে।”
জগাই তবু নির্বিকার। যে করেই হোক তিনকড়িকে তার চাই। আর তার মত পাগলকে বোঝানো যার তার কর্ম নয়। সুতরাং চুপচাপ মজা নিতে লাগল সবাই।
-“এখন কেমন লাগছে দাদু ?”
পরিচিত আওয়াজে পেছন ফিরল তিনকড়ি । তনিমা দাঁড়িয়ে। ব্যাপারস্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
-“আমাদের সঙ্গে যখন অভদ্রতা করেন, যখন আমাদের অসহায়তার সূযোগ নেন, ছিনাল বলেন, তখন আমাদের এরকমই লাগে। আসলে কি জানেন, কোনও খারাপ ঘটনা নিজের উপর যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারা যায় না। এ ঘটনার পর আশাকরি আপনার বোধোদয় হবে।”
তনিমার কথাশুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তিনকড়ি। তনিমার বক্তব্য বুঝতে পারলেও তার নিজের উপর হওয়া ঘটনার মানে বুঝতে পারছে না তিনকড়ি। আর ঠিক তখনই একটা আয়না এনে তিনকড়ির সামনে ধরল বিলাসী। আয়নার দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল তিনকড়ি।
এ কাকে দেখছে সে ? এ তো তিনকড়ি নয়। এ কোনও মালতি বা মিনতি। ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল, আইলাইনার, গালে মেকআপ। পাজী মেয়েছেলেটা ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে এসব করেছে। কেঁদে ফেলল তিনকড়ি । দু’চোখের কোল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।
প্রিয়তমার দুঃখে কাতর হয়ে কাঁদতে লাগল জগাই। তিনকড়িকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে করে সে কি কান্না ! বাপ মা মরলেও এমন কাঁদে না কেউ।
তিন
ফল্গু নদীতে এসেছে সবাই। তবে সবাই যে পিন্ড দেবে তা নয়। এদের মধ্যে অনেকেই বেড়াতে এসেছে। তারা গয়া কাশী বৃন্দাবন মথুরা দেখে ঘরে ফিরবে। আর যারা পিন্ড দেবে তারা এসেছে না খেয়ে উপোষ করে। বালির পিণ্ড দেবে এখানে।
ঠাকুরমশাই বলে চলেছেন ফল্গুমাহাত্ম্য।
ত্রেতাযুগে ভগবান রাম আসেন বনবাসে। ঘুরতে ঘুরতে গয়ায় এসে পিতৃশ্রাদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শ্রাদ্ধের জন্য দরকার ঘি মধু তিলের মতো জিনিসের। সেগুলো পেতে যেতে হবে জনবসতিতে। ফল্গুর তীরে সীতাদেবীকে রেখে রাম ও লক্ষ্মণ যান ঘি মধু আনতে।
রাম ও লক্ষ্মণের দেরি দেখে রাজা দশরথ আবির্ভূত হন সীতাদেবীর সামনে। বললেন তার অসহায়তার কথা। বললেন,"আর তো দেরি সয় না মা।"
‘বালির পিন্ড দাও মা সীতা বলছি তোমায় বারম্বার।
চৌদ্দদণ্ড বেলা হলে দাঁড়াবার নাই অধিকার।।
বালির পিন্ড দাও মা সীতা, পিন্ড দাও মা জননী ।
তোমার হাতের পিন্ড নিয়ে স্বর্গ যাব এখনই।।’
মা সীতা তখন বালির পিন্ড তৈরি করে প্রদান করেন। সেই থেকে বালির পিন্ডের প্রচলন।
এদিকে পিন্ড নিয়ে অন্তর্হিত হন রাজা দশরথ। রাম ও লক্ষ্মণ ফিরে এলে তাদের সবকথা বললেন মা সীতা । কিন্তু ভগবান রাম সেকথা বিশ্বাস করলেন না। ডাক পড়ল সাক্ষীদের। কিন্তু ব্রাহ্মণ, অশত্থবৃক্ষ, গরু, কাকের সঙ্গে ফল্গুনদীও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। মা সীতা তখন ফল্গু নদীকে অন্তঃসলিলা হবার শাপ দেন। ফল্গু তখন হতেই অন্তঃসলিলা।
চলবে….
Subrata Majumdar