আজি বসন্তে – পর্ব ৬ // সুব্রত মজুমদার

#আজি_বসন্তে (পর্ব ৬ )

#সুব্রত_মজুমদার

             একটা ছেলে এল বিরাটি হতে। আবগারির সাবইনস্পেক্টর। মেদবহুল সে ছেলের পদভরে কম্পিত হতে লাগল মেদিনী। নিজের প্লেটের সিঙাড়া শেষ করে সঙ্গে আসা বাপ মা আর মাসতুতো ভাইয়ের প্লেটেও থাবা বসাল। বাবা মা তাদের অকৃপণ স্নেহে প্লেটের সিঙাড়া মিষ্টিগুলো এগিয়ে দিলেও মাসতুতো ভাই তা করল না। সে রীতিমত বিদ্রোহ ঘোষণা করল।

      হবুবরের এহেন আচরণে তনিমার হৃদয়ও বিদীর্ণ হল। সে রান্নাঘর হতে বাকি সিঙাড়াগুলো এনে বৌদির হাতে দিয়ে বলল, "ঘটোৎকচের পেট ভরিয়ে এস।"

সুরঞ্জনার গালে হাত দিয়ে বলল, “এ কি গো ননদী, বিয়ে হতে না হতেই এত প্রেম ? যাই বল ভাই এত প্রেম তোমার দাদার আর আমার মধ্যেও ছিল না।”

“ধ্যাৎ” বলে মুখ ঘুরিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তনিমা। বলাই বাহুল্য সে সম্মন্ধটা পত্রপাঠ নাকচ হয়ে গেল। সে সপ্তাহেই এলেন আরেক মূর্তিমান। ছেলে প্রফেসর, নিজের পেশার পাশাপাশি টিভিতেও বিভিন্ন বিষয়ে বাদানুবাদ করে সে।

মুখ দেখেই চিনতে পারল তনিমা। বৌদির কানে কানে বলল, “ওমা, এ তো সেই বাচাল লোকটা। সব বিষয়েই জ্ঞান রাখে। চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কাউকেই তিষ্ঠোতে দেয় না। আমি বাপু এই ছেলের সাথে ঘর করতে পারব না। আমাকে তো মুখ খুলতেই দেবে না।”

সুরঞ্জনা লাজ লজ্জার বালাই রাখে না। সে তুলেই ফেলল প্রসঙ্গটা। শুনে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল ছেলেটার। টেবিল হতে জলের গ্লাসটা নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে বলল,”ডিবেটের ব্যাপার আলাদা। আসলে আমার সঙ্গে এঁটে ওঠার মতো লোক নেই তাই ওরকম মনে হয়। বিয়ের পর ঘরে বসে বসে তর্ক করব একথা মনে এল কিভাবে ?”

উঠে পড়ল ছেলে। তার নাকি জরুরি কাজ আছে, বেশিক্ষণ বসলে হবে না।

তিননম্বর পাত্রটা মায়ের আঁচলধরা ছেলে, চতুর্থটি কথায় কথায় নাক ঝাড়ে। কার্যতই তনিমার বিয়ে নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেল ঘরের লোক। মা বললেন,”এরকম বাছবিচার করলে তোর আর বিয়েই হবে না। তোর বাবাও সামনে বছর রিটায়ার্ড করবে। তুই কি আমাদের যন্ত্রণা দিবি ?”

মা বাবাকে আর যন্ত্রণা দিতে চাইল না তনিমা। যে সম্মন্ধই আসবে সেটাই ফাইনাল। আর ভাববে না সে। যা কপালে আছে আছে। সে বুড়োই হোক আর হোঁদলকুতকুতই হোক।

পরের বুধবারই এল নতুন সম্মন্ধ। ডাঃ স্বর্ণেন্দু রায়। পাল্টিঘর না হলেও পাত্র প্রতিষ্ঠিত। পিজি হাসপাতালের লেকচারার। মেডিক্যাল শিক্ষক। ছেলেটার চেহারাটাও বেশ। সহজেই মন কেড়ে নিল তনিমার। স্বর্ণেন্দুরও পছন্দ হয়ে গেল তনিমাকে। বৌদি আড়ালে ডেকে বলল, “তাহলে ? ডাক্তারবাবুটার কপালে শিকে ছিঁড়ল ?”

কোনও উত্তর দিল না তনিমা, ফিক করে হেসে দৌড়ে চলে গেল। সুরঞ্জনাও হাসতে লাগল।

-“গয়া এসে পড়েছে, নেমে পড় সবাই।” হাঁকলেন মাধববাবু।
চোখ খুলল তনিমা। কাল রাতে অতীতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। বাস হতে নেমেই চোখেমুখে জল নিয়ে গেল মাধববাবুর কাছে। মাধববাবু জলখাবারের তদারকি করছিলেন। তনিমাকে দেখেই বললেন, “কিছু বলবে মা ?”

-“হ্যাঁ, আজই কি পিণ্ড দিতে হবে ? মানে খাওয়া দাওয়া… ?”
-“না মা, যা হবে কাল।” মাধববাবু বললেন। “কাল সকাল হতেই শুরু হবে। প্রথমে ফল্গুনদী, পরে বিষ্ণুপদে ও শেষে অক্ষয়বটে। অপঘাতে মৃত্যু হলে প্রেতশীলাতে। সে এখান হতে অনেকটাই দূরে।”

বাসের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা হয়ে গেল জগাইয়ের সঙ্গে। আর জগাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া মানেই একগাদা অর্থহীন কথা শুনে যাওয়া। জগাইকে দেখে মোটেও বিরক্ত হল না তনিমা। তার একাকিত্বের জীবনে জগাইয়ের মত মানুষ তো পরম পাওয়া।

-“গুড মর্নিং দিদি। ” একগাল হেসে বলল জগাই।
তনিমাও তার জুঁইফুলের মতো মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে বলল, “গুড মর্নিং। যাচ্ছ কোথায় ?”
-“এই একটু চায়ের সন্ধানে। আমার আবার পেটে চা না পড়লে….”
বাকিটুকু আর বলতে দিল না তনিমা, মাঝপথেই থামিয়ে দিল। জগাইও কথা থামিয়ে হাসতে লাগল। হাসি থামতেই বলল, “আমার গার্লফ্রেন্ডও ওরকমই থামিয়ে দিত।”

তনিমা হেসে বলল, “যে কেউ থামিয়ে দেবে। কি করে মরল তোমার গার্লফ্রেন্ড ?”
আবার একগাল হেসে জগাই বলল,”মরেনি তো, ভেগেছে। দলবদল। তাইতো এসেছি গয়াতে পিণ্ডি দিতে। ওর আত্মা শান্তি পাক।” বলেই আবার হাসতে শুরু করল। সে হাসি থামানো মুশকিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাসের দিকে হেঁটে চলল তনিমা।

ঠাকরুন আর বিলাসী নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। বিলাসী বলছে তার শ্বশুরের গল্প। একমনে শুনছেন ঠাকরুন। তনিমা এসে যোগ দিল সেই আসরে।
-“কি বলব কাকি, শ্বশুর আমার জাঁদরেল ছিল। চৌকিদার ছ্যাল তো, চারখানা গাঁয়ের লোক ভয়ে তটস্থ থাকত।….”

বিলাসী হারিয়ে গেল নিজের অতীতে। তার বর্ণনা মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল শ্রোতাদের মানসচক্ষে। বিলাসীর শ্বশুর ছিল গ্রামের চৌকিদার। সেকালে চৌকিদাররদের বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। গ্রামে কোনও ফোজদারি ঘটনা ঘটলে চৌকিদার এসে হাজির হত। অভিযুক্তকে বেঁধে নিয়ে যেত থানায়। আবার থানার সমনও নিয়ে আসত চৌকিদার। পুলিশের চর সন্দেহে গুপ্তকথা খুলে বলত না কেউ।

        সেই ভূষণ চৌকিদার যখন দেখলেন যে তার ছেলেমেয়েরা কোনও কাজের হল না তখন খুবই মর্মাহত হলেন। ভূষণ চৌকিদারের আশা ছিল তার ছেলেদের অন্তত কেউ একজন পরবর্তী চৌকিদার হবে। কিন্তু এককলমও লেখাপড়া শিখল না ছেলেরা। ভূষণের আমলে চৌকিদার পদের জন্য লেখাপড়ার তেমন দরকার ছিল না, কিন্তু এখন নিয়ম কানুন পাল্টেছে, এখন আর উপায় নেই।

     ভূষণের বড়ছেলে বলাই লায়েক হয়েছে। বাপের পয়সায় খায়দায় আর ঘুরে বেড়ায়। দেখেশুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ভূষণ। সবই অদৃষ্ট। এবার বিয়ে দিয়ে পৃথক করে দিতে হবে। আলাদা সংসার হলে কাঁধের উপর চাপ বাড়বে, কাজকর্মে মতি হবে।

ভূষণ চৌকিদার কাজের লোক ভাবামাত্রই কনেদেখা শুরু করে দিল সে । অনেক খুঁজেপেতে একটা সম্মন্ধ পেল। পালটি ঘর। মেয়ের বাবার যথেষ্ট জমিজমা আছে। তিন তিনখানা পুকুর। পাওনাগণ্ডাও দেবে যথেষ্ট।

বৈশাখের এক রাতে চারচোখে এক মন হয়ে গেল বিলাসী আর বলাইয়ের। সবাই বলল রাজজোটক হয়েছে। বলাইয়ের মা বলল, “ছেলে আমার সোনারচাঁদ, এখন বৌমা ভালো হলেই ভালো।”

        শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিনেই হেঁশেলে ঢুকতে হল বিলাসীকে। বছর চৌদ্দর বিলাসীর কাঁধে পড়ল শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী আর তিন ভাসুরকে দুবেলা রেঁধে খাওয়ানোর দায়িত্ব। শাশুড়ি সেই যে রান্নাঘর ছাড়লেন আর ওমুখো হলেন না। বিলাসীর উপরে নির্ভরতা এতই বাড়ল যে বাপের বাড়িতে গিয়ে দুদিন থাকারও উপায় রইল না।

বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় শ্বশুরমশাই গম্ভীর গলায় বলতেন, “বৌমা, যাচ্ছ যাও কিন্তু শেকড় গেড়ে বসে যেও না যেন। তোমার শাশুড়ির বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে, এতগুলো লোকের রান্না..।”

বিলাসী শ্বশুরকে ভয় করে চলত। তার সাহস ছিল না শ্বশুরের কথা অমান্য করে দুদিন বেশি থাকা। চোখের জলে বিদায় নিত বাপের বাড়ি হতে। বিলাসীর বাবা দু’একবার বিয়াইয়ের কথা অমান্য করে মেয়েকে রেখে দিয়েছিল । কিন্তু সে নিয়ে যে অশান্তি হয়েছিল তা কহতব্য নয়। বিলাসী অশান্তিকে ভয় করে সুতরাং বাবাকে বোঝায় সে। মেয়ে পরের ধন। বিয়ের পর তার উপর আর বাপের দাবি থাকে না।
চলবে…

Subrata Majumdar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *