আজি বসন্তে – পর্ব ৫ // সুব্রত মজুমদার

#আজি_বসন্তে (পর্ব ৫)

#সুব্রত_মজুমদার

বুড়ো তিনকড়ির মুখে রা বের হল না। দোষটা তারই। অনেকের কাছেই নিজের অতীত জীবনের গৌরবের কথাগুলো বলতে গিয়ে চাঁপা বোষ্টমীর কথা বলে ফেলেছে সে । এখন মার খাওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই। শেষমূহূর্তে মাধববাবু এসে না দাঁড়ালে কি যে হত তা বলা মুশকিল।

মাধববাবু এসে বোষ্টমীর সামনে দাঁড়ালেন । বললেন , “এ কি করছ বোষ্টমী, তুমি না নিজেকে ভগবানের চরণে সঁপে দিয়েছ ! আর যাই হোক উনি এখন অসুস্থ, অসুস্থ লোককে এমন নির্যাতন উচিত নয়। আর তিনকড়িবাবু, আপনিও বলিহারি, কেন যান ওসব কথাবার্তায় ?”

হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল বোষ্টমী। তিনকড়ি ঘোষ চুপ করে বসে রইল। কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই সে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতেই বিকেল হয়ে এল। ততক্ষণে রাস্তার জ্যামও ছেড়ে গেছে। সবাইকে গুটিয়ে নিয়ে বাস চলতে লাগল ঝড়ের গতিতে। জানালার দিকে তাকিয়ে সুদূর অতীতে ডুবে গেল তনিমা। সোনালি রোদে মাখা সেই সুদূর অতীতে।

                              - দুই -

       পৌষের পড়ন্ত বিকেল, মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে ছাদের উপর। যাবার সময় রাঙিয়ে দিয়ে যেতে চায় সে। এসময়ের রোদের এমনই মায়া যে ছেড়ে যাওয়া যায় না। তনিমাও পারছে না এই পড়ে আসা রোদের মায়া কাটিয়ে নিচে নেমে আসতে। একটা অর্কিডের টব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে সে। হঠাৎই একটা পেছনদিক হতে একটা হাত এসে চোখদুটো চেপে ধরল।

তনিমা হাসি হাসি মুখে বলল, “বৌদিভাই …”
তনিমার চোখদুটো চেপে ধরা হাতদুটোর মালিক খিলখিল করে হেসে বলল, “কি করে বুঝলি ?”
তনিমা বলল, “তোমার গা হতে বেরোনো ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। এ বাড়িতে ওটা ইউনিক। তোমার নামেই পেটেন্ট করা। তাই ল্যাভেন্ডারের গন্ধ নাকে আসতেই বুঝেছি এ আমার বৌদিভাই।”

তনিমার দাদার বৌ সুরঞ্জনা। ভালোবাসা করে বিয়ে। বাবা মায়ের অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল সুরঞ্জনা। সে এক হৈহৈ ব্যাপার। তনিমার মা তো বলেই দিয়েছিলেন যে ওই বৌকে তিনি ঘরে তুলবেন না। আর সেই সঙ্গে নিজের ছেলেকেও ত্যজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন।

ঠিক এসময়ই এগিয়ে এল তনিমা। মায়ের হাত ধরে বলল, “দেখ মা, যা হওয়ার তো হয়েই গেছে কিন্তু ওই মেয়েটার কি দোষ ? বেচারাকে বাপের বাড়িতেও ঢুকতে দিচ্ছে না। শাশুড়ি না হয়ে একবার মা হয়েও তো ভাবতে পার বিষয়টা।”

-“তাহলে কি করতে বলিস তুই ?”
-“ওদের মেনে নাও। আহা, কি নিস্পাপ মুখ ! প্লিজ মা…”

বহু অনুনয় বিনয়ের পর মা রাজি হলেন। ঘরে এল সুরঞ্জনা। সত্যিই মা লক্ষ্মী সে। যেমন রূপে তেমনি গুনে। দু’একদিনের মধ্যেই শ্বশুর বাড়ির সবার মন জয় করে নিল সে। তনিমাও একটা কাছের লোক পেল, যার কাছে মনের সব কথা খুলে বলা যায়।

চোখ হতে হাত সরিয়ে সুরঞ্জনা বলল,”কি ননদী, কার কথা চিন্তা করছ ?”
তনিমা একটু ভেবে নেওয়ার ভান করে বলল, “সে এক রাজপুত্তুরের, হাতে খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে সাদা ঘোড়ায় চেপে আসবে। ওর কালো মেঘের মতো দুটো চোখের তারায় থাকবে একরাশ ভালোবাসা। শুধু.. শুধু আমার জন্য।”

-“তাহলে তো তোমাকে আরও কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে ভাই। সত্যযুগ না এলে তো ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার মিলবে না। তবে আমার সন্ধানে কিছু এনফিল্ড চড়া রাজকুমার আছে। দেখবে ? এত্তেল্লা দেব ?”

গম্ভীর গলায় তনিমা বলল,”তবে তাই হোক উজির, এত্তেল্লা পাঠাও।”
কুর্নিশের ভঙ্গিতে সুরঞ্জনা বলল,”যো আজ্ঞা খোদাবন্দ। ”
তনিমা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল,”রক্ষা কর আমাকে, বিয়ের হুজ্জুত আমার পোষাবে না গো। যা দেখলাম তোমাদের বেলায়। ”
-” তুমি তো আর আমাদের মতো পালিয়ে বিয়ে করছ না। নাকি সে ইচ্ছা আছে ? ”
-“মোটেও নেই। ওই ‘হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে’ মার্কা কথাবার্তায় আমার বিশ্বাস নেই।”
সুরঞ্জনা হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে শুরু করি খোঁজ ?”

হেসে উঠল তনিমা। এ হাসি মনের ভেতরের বকুলকলির প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠার লক্ষণ। অভিজ্ঞ সুরঞ্জনা তা বেশ বুঝতে পারল। তাই ছুটে গেল শাশুড়িমায়ের কাছে।

সব শুনে শাশুড়ি বললেন,”কালকেই কথাটা বলছিলাম তোমার বাবাকে। তা উনি তো হুঁ হাঁ করেই ঘুমিয়ে পড়লেন। কোনও চিন্তাভাবনা নেই লোকটার। সারাজীবন শুধু আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খেল।”

বেচারা শ্বশুরকে বাঁচাতে মাঠে নামল সুরঞ্জনা। বলল, “বাবার আর কি দোষ, সারাদিন অফিসের চাপ তারপর বয়সও তো হয়েছে উনার।”

শাশুড়ি বাধা দিয়ে বললেন,”না মা না, লোকটা বরাবরই ওইরকম। কোনও কালেই কোনও কাজ ঠিকঠাক করেনি। খোকার জন্মের সময় গাড়ি ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল আমার বুড়ো শ্বশুর, তোমার বাবা তো টেনশনে হেলেকেঁপে একেক্কার।”

সুরঞ্জনা বুঝল যে সে শ্বশুর আর শাশুড়ির দাম্পত্য কলহের মাঝে পড়ে গেছে। সুতরাং কেটে পড়াই মঙ্গল। এই বুড়োবুড়ির ঝগড়া মেটা অসম্ভব। সামনে বছরই রিটায়ার্ড হবেন শ্বশুরমশাই তখন যে কি হবে সেই ভেবে শিউরে উঠল সুরঞ্জনা। সারাদিন বুড়োবুড়ির দ্বৈরথ হবে।

পরের সপ্তাহ হতেই সম্মন্ধ আসা শুরু হল। উদ্যোগ অবশ্য সুরঞ্জনারই। নিজের ফ্রেন্ডসার্কেল হতে শুরু করে আত্মীয়স্বজন চেনাশোনা সবাইকেই অনুরোধ করেছে সে। ননদের জন্য একটা পাত্র খুঁজে দিতে হবে। এইসব অনুরোধ উপরোধের ফল ফলতে শুরু করেছে।

          একটা ছেলে এল বিরাটি হতে। আবগারির সাবইনস্পেক্টর। মেদবহুল সে ছেলের পদভরে কম্পিত হতে লাগল মেদিনী। নিজের প্লেটের সিঙাড়া শেষ করে সঙ্গে আসা বাপ মা আর মাসতুতো ভাইয়ের প্লেটেও থাবা বসাল। বাবা মা তাদের অকৃপণ স্নেহে প্লেটের সিঙাড়া মিষ্টিগুলো এগিয়ে দিলেও মাসতুতো ভাই তা করল না। সে রীতিমত বিদ্রোহ ঘোষণা করল।

হবুবরের এহেন আচরণে তনিমার হৃদয়ও বিদীর্ণ হল। সে রান্নাঘর হতে বাকি সিঙাড়াগুলো এনে বৌদির হাতে দিয়ে বলল, “ঘটোৎকচের পেট ভরিয়ে এস।”
চলবে….

Subrata Majumdar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *