আজি বসন্তে – পর্ব ৪

#আজি_বসন্তে (পর্ব ৪ )

#সুব্রত_মজুমদার

মাধববাবু গেলেন ডাঃ গাঙ্গুলীর কাছে। ডাঃ গাঙ্গুলীও এই বাসেরই এক যাত্রী। অবসরপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার ইনি। স্ত্রীকে নিয়ে উত্তরভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন।

-“কিছু তো একটা করতে হয় ডাক্তারবাবু। যা পয়সা লাগে আমি দেব।”

তিনকড়ি এলে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ডাঃ গাঙ্গুলীর কাছে। সব দেখেশুনে ডাক্তারবাবু বললেন, “ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। তবে কি জানেন ঘোষমশাই, বয়স হয়েছে তো একটু বুঝেসুঝে খেতে হবে। ওই জোয়ান ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে নিজেকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ”

ডাক্তারের কথা শুনে বেশ রেগে গেল তিনকড়ি। মুখ বেঁকিয়ে বলল, “কত টাকা দিয়েছে ওই মাধব দাস ? কেস করলে আপনাকেও সমন করা হবে ডাক্তার। ক্ষতিপূরণ আমি নিয়েই ছাড়ব। ‘দেশোদ্ধার পার্টি’ র নাম শুনেছেন ? দীর্ঘ তিরিশ বছর ওই পার্টির জোনাল কমিটির সম্পাদক ছিলাম। অনেক দেখেছি মশাই।”

ওষুধপত্র দিয়েই উঠে গেলেন ডাক্তার। গাছের ছায়াতে চাদর বিছিয়ে ঘুমোতে লাগল তিনকড়ি । ঘুমোলে যদি কোনও উপকার হয়। এসব বুড়ো হাবড়া ডাক্তারের ওষুধকে তো বিশ্বাস করা যায় না।

এদিকে একটা কৃষ্ণচূড়ার তলায় ঠাকরুন বসেছেন গল্প বলতে। তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন শ্রোতা। শ্রোতাদের মধ্যে তনিমা আর বিলাসী যেমন আছে তেমনি আছে চাঁপা বোষ্টমী। আজ বছর দশ হল ঘর ছেড়েছে বোষ্টমী। স্বামী ছেড়েছে তারও বহু আগে। বলা ভালো স্বামীকেই ছেড়ে দিয়েছে সে ।

খানতিনেক ছেলেমেয়ে হওয়ার পর বোষ্টমীর মনে ভাব আসল। পাশের পাড়ার হারু কামারের ছেলেকে নিয়ে বোষ্টম হল সে। গাঁয়ের শেষে নদীর ধারে আখড়া বানিয়ে ভজনসাধন করতে শুরু করল। নানালোকে নানারকম বললেও বোষ্টমীর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

স্বামী আসে মাঝে মাঝে। পুরোনো প্রেম উথলে উঠলে বাধা দিয়ে বোষ্টমী বলে, “না গো মিতার বাবা, এখন আমি আর তুমি আলাদা জগতের লোক। আমি ভগবানের শ্রীচরণে এসে আশ্রয় নিয়েছি, আর তুমি পাপের পাঁকে ডুবে আছ। বল হরি….”

বোষ্টমীর স্বামী বিরক্ত হয়ে বলে, “তুই বল্ মুখপুড়ি, বেঁচে থাকতেই ইহকাল নষ্ট হয়ে গেল আমার তো পরকাল ! তোর পরকাল নিয়ে তুই থাক।” রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল লোকটা।

ঠাকরুন বলছেন শ্রীহরির গায়ের চন্দনের কথা। কিভাবে ভক্তের মল হতে চন্দনের উৎপত্তি হল। মন দিয়ে শুনছে সবাই। তনিমাও শুনছে অবাক হয়ে। ঠাকরুন বলে চলেছেন –

“তা একদিন নারদ এলেন নারায়ণের কাছে। বিভিন্ন রকম আলোচনা করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা প্রভু এই ক্ষীরোদ সাগর ছাড়া আর কোথায় অবস্থান করেন আপনি ?’

ভগবান বললেন,’হে নারদ, আমার অবস্থান এই জগতের সর্বত্রই। যেখানে চোখ পড়বে সেখানেই আমি।’
এই শুনে পুলকিত হল নারদ। আর রোজ রোজ এতদূর আসার দরকার নেই। ঘরে বসেই দর্শন হবে। এদিকে কিছুসময় পরে প্রকৃতির ডাকে বিহ্বল হয়ে উঠল নারদ। কিন্তু মলত্যাগ করবেন কোথায় ! সর্বত্রই তো শ্রীহরি। তাই যোগবলে মলকে দেহেই অবরুদ্ধ করে রাখলেন তিনি।

এদিকে দেহের মধ্যে মল সঞ্চিত হওয়ার জন্য দেহ হয়ে উঠল দুর্গন্ধময়। ভগবানের কাছে যেতেই নাকে হাত দিয়ে ভগবান বললেন, ‘এ কি নারদ, তোমার দেহ হতে এত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে কেন ? তোমার শরীর হতে তো পদ্মের সৌরভ বের হয়।’

সব কথা খুলে বললেন নারদ । শুনে ভগবান বললেন, ‘এ কি করেছ নারদ ? মল মানেই নিষ্কাশন যোগ্য। মল মানেই মলিন। তোমার মতো পন্ডিত সর্বজ্ঞ লোক এই তত্ত্ব ভুলে গেল কিভাবে ?’

নারদ গেলেন মলত্যাগ করতে। এত এত মলত্যাগ করলেন যে একটা পর্বতের সৃষ্টি হল। মলয় পর্বত। ভগবানের ইচ্ছাতে সেই মলের দুর্গন্ধ ঘুচে গিয়ে সুগন্ধযুক্ত হল। সৃষ্টি হল চন্দনের। যে ভক্ত ভগবানের কথা বিশ্বাস করে নিজের মলত্যাগ পর্যন্ত করেনি সেই ভক্ত সত্যিই মহান। তাই ভক্তকে মান্যতা দিতেই সেই মলয় চন্দন শ্রীঅঙ্গে ধারণ করলেন শ্রীহরি।”

-“ভক্ত বড় শক্ত কথা গো। আমার অলপ্পেয়ে মুনসেট যদি বুঝত।” কপালে হাত ঠেকাল বোষ্টমী।

জগাই দাঁত বের করে হেসে বলল,” বুঝলেও কোনও কাজ হত না বৈষ্ণবী, ওর ইয়েতে চন্দন হত না কোনোদিন। ঠিক যেমন তিনকড়ি কাকার ইয়েতে….. হি হি হি…. কি দুর্গন্ধ !”

জগাইকে থামাবার ক্ষমতা কারোর নেই। সে হাকিম হুকুম কিল চড় কিচ্ছু মানে না। আর এজন্যই বোধহয় ওর প্রেমিকা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। পাগলের সঙ্গে থাকাটা যে কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।

ফিটফাট সুপুরুষ একটা ছেলেকে ভালোবেসেছিল টিনা। কি সুন্দর চেহারা, দাঁতগুলো মুক্তোর মতো। পুরুষ মানুষের এত রূপ হয় না। আর শুধুই কি রূপ, ফিজিক্স আর অঙ্ক দুটো বিষয়েই এমএ জগাই। কিন্তু সর্বনাশ হল অক্সফোর্ড ডিকশনারিটা মুখস্থ করতে গিয়ে। একে তো মেধাবীরা একটু পাগলাটেই হয়, তার উপর অক্সফোর্ডের ষাঁড়ের গুঁতো, – মাথার তারগুলো পার্মানেন্টভাবেই ছিঁড়ে গেল।

জগাইকে ছেড়ে চলে গেল টিনা। হার্ডওয়্যারের দোকানের পিন্টুর গলায় গিয়ে ঝুলল। সে কি মাতামাতি ! জগাই যেখানেই যায় সেখানেই দেখে পিন্টু আর টিনা। সব জায়গাতেই জোড় বেঁধে বসে আছে। মাথা ঘুরে গেল জগাইয়ের।

একদিন পিন্টুর ঘরের সামনে জগাইয়ের সে কি চিৎকার। পারলে পিন্টুকে মেরে ফাঁসিই চলে যায়। কিন্তু দমে গেল তখনই যখন টিনা এসে বলল, “এই পাগলা, ভাগ। তোর সঙ্গে আমার প্রেম ফ্রেম কিচ্ছুই ছিল না। পাগলের সঙ্গে আবার প্রেম কিসের ?”

সেদিন কেঁদে ফেলেছিল জগাই। সেই শেষ কাঁদা। এরপর আর কেউ কোনোদিন চোখে জল দেখেনি জগাইয়ের। এখন সে সর্বদাই হাসে। দুঃখকে সে জয় করেই ফেলেছে। কেউ কিছু বললে বলে, “যার ব্রেনের সব তার গুলোই ঢিলে তার আবার ইমোশন ! আমার ইমোশন নয় রে মোশন আসে….. লুজ মোশন।”

বোষ্টমীর কথা শুনে বিলাসী বলে, “আমাদের লোকটাও খুব হরিভক্ত ছিল গো। তবে যাই বল তাই বল বোষ্টমবউ এয়োতি হয়ে সোয়ামি ছেড়ে……. খুব খারাপ কাজ। এই তো এতবছরেও কেউ বলতে পারবে না যি বিলাসী কোনও পরের মরদের দিকে তাকিয়েছে।”

বিলাসীর কথা শুনে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসতে লাগল জগাই। একবার বিলাসী তো একবার বোষ্টমীর দিকে তাকাতে লাগল। বোষ্টমী তো রাগে ফুঁসতে লাগল। প্রথমেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল জগাইকে।

-“এই দামড়া, মেয়েছেলেদের মাঝে তোর কি কাজ রে ?” এরপর আক্রমণ নেমে এল বিলাসীর দিকে, “আর তুমি তো ধোওয়া তুলসীপাতা মা । তুমি সংসারের জীব, এর বেশি জানবেই বা কি। নরকে পচে মরবে বাছা।”

তারপরেই হঠাৎ কি মনে হতেই পাশে পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল তুলে নিয়ে ছুটে গেল কিছুদূরের আমগাছটার দিকে। ওই গাছটার তলাতেই চাদর পেতে শুয়ে আছে তিনকড়ি। এই তিনকড়ির সঙ্গেই কিছুদিন একটা মাখোমাখো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বোষ্টমীর। তখন অবশ্য বোষ্টমী বোষ্টমী হয়নি। সবেমাত্র প্রথম ছেলেটা হয়েছে। বোষ্টমীর দৃঢ় বিশ্বাস ওই তিনকড়িই তার ব্যাপারে সবাইকে বলেছে।

গাছের ছায়ায় শুয়ে টকঝালমিষ্টি স্বপ্ন দেখছিল তিনকড়ি। যে স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল তনিমা। হঠাৎই একটা প্রবল চিৎকারের স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। চোখ খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে চাঁপা বোষ্টমী। একটা শুকনো ডালের লাঠি হাতে তারস্বরে চিৎকার করছে।

-“মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব রে বুড়ো। তীর্থধর্ম করতে এসেও তোর স্বভাব গেল না। আমার নামে যা তা বলে বেড়াস।”

বুড়ো তিনকড়ির মুখে রা বের হল না। দোষটা তারই। অনেকের কাছেই নিজের অতীত জীবনের গৌরবের কথাগুলো বলতে গিয়ে চাঁপা বোষ্টমীর কথা বলে ফেলেছে।
চলবে….

Subrata Majumdar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *