আজি বসন্তে – পর্ব ৩

#আজি_বসন্তে (পর্ব ৩)

#সুব্রত_মজুমদার

আবার সেই খিঁক খিঁক শব্দে হেসে উঠল বুড়ো। হাসতে হাসতে কেশে ফেলল। তারপর অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে বলল, “পাগলের কথা ধরছেন কেন মশাই ! ও আস্ত একটা পাগল মেয়েছেলে, আর নাহয় ছিনাল। নাহলে ভাবুন বিধবা হয়ে রঙিন শাড়ি পরে ঠোঁটে লিপস্টিক নিয়ে কেউ ঘোরে।”
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন মাধববাবু “ইউ……”

কটুকথা বলতে গিয়েও থেমে যেতে হল মাধব দাসকে। ব্যবসার খাতিরে গাধাকেও বাপ বলতে হয়, পেটের দায় বড় দায়। বলতে পারলেন না কটুকথা। গলা নামিয়ে বললেন,”অপরের ব্যক্তিগত জীবনে দখলদারি করি উচিত নয়। অনেক তো বয়স হল, এবার একটু ভগবানের নাম করুন।”

চলে গেলেন মাধববাবু, বেজার মুখে বসে রইলেন তিনকড়ি ঘোষ। ওদিকে জলখাবার তৈরি, বিলি করা শুরু হয়ে গেছে। গরম গরম বেগুনি, মুড়ি আর শশা। সকালের জলখাবার খেতে দেরি হল, নিশ্চিত ভাবেই দুপুরের খাবারে দেরি হবে।

খাওয়া দাওয়ার পর আবার ছুটতে লাগল বাস। জানালার ধারেই তনিমার সিট। কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দুরন্ত প্রকৃতিকে নির্নিমেষ নয়নে দেখছে সে। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে গাছপালা আর ঘরবাড়ি। মূহুর্তে মূহুর্তে বদল হচ্ছে প্রকৃতিপট। সেদিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে যায় তনিমা। জীবন তো এমনই, জন্ম হতে মৃত্যুর দিকে ছুটে চলা। যাব না বললেও উপায় নেই ছুটতে হবেই। চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাবে সময়।

তনিমার মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম নিভৃতে দেখাকরেছিল ওরা। পার্কের বেঞ্চে বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছিল তনিমা। যত দায় যেন তার। চারটেয় টাইম দিয়ে পাত্তা নেই বাবুর। একবার আসুক আচ্ছা করে বকে দেবে তনিমা। বলবে, “এই যে মশাই, এরকম চলবে না, সময়জ্ঞান আর দায়িত্ববোধ যে ছেলের নেই তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে মুশকিল।”
কিন্তু স্বর্ণেন্দুর মুখের দিকে চেয়ে সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল। একে কি কিছু বলা যায় ! এত কিউট যে……. একগাল হেসে এগিয়ে গেল তনিমা । স্বর্ণেন্দুর মুখেও শিশুসুলভ হাসি।

-“অনেক দেরি হয়ে গেল। আসলে অফিস হতে বেরোনোই মুশকিল। তিনটে নাগাদ গুটিয়ে পাটিয়ে যেই বেরোতে গেছি অমনি চক্রবর্ত্তী এসে একগাদা ফাইল নামিয়ে দিয়ে গেল, আজকেই রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। বড়সাহেবের অর্ডার। শেষমেশ পেটখারাপের অভিনয় করে ছাড়া পেয়েছি।”
তনিমা হেসে বলল, “কিছু তো খাবে, নাকি পেট এখনও ঠিক হয়নি ?”
হো হো করে হেসে উঠল স্বর্ণেন্দু, বলল,”লেটস গো… লেটস গো….. ”

কফিসপে বসে কবিরাজি কাটলেট সহযোগে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কত কথা হল ওদের। অবশেষে স্বর্ণেন্দু তার ব্যাগ হতে বের করল একটা ভেলভেটের চৌকো বাক্স। বাক্সের ভেতরে সযত্নে শায়িত একটা সোনার হার। উঠে গিয়ে পরিয়ে দিল স্বর্ণেন্দু। তনিমার মুখে তখন স্বর্গীয় প্রশান্তি।

আজও সযতনে রেখেছে সে হারখানা। কিছু স্মৃতি চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। আর এই স্মৃতি নিয়েই তো বেঁচে আছে তনিমা।

একটা তীব্র ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফিরল তনিমার। বাসটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনে নাকি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রাস্তা বন্ধ। জ্যাম কখন ছাড়বে বলা মুশকিল।

ড্রাইভারের কাছে গিয়ে মাধববাবু বললেন, “যা দেখছি তাতে জ্যাম ছাড়তে রাত হয়ে যাবে। পাশের ওই মাঠেই নামিয়ে দাও বাসটা। দুপুরের খাওয়া দাওয়াটা সেরে নিই তারপর দেখা যাবে।”

ড্রাইভার অতি সাবধানে বাসটাকে নামিয়ে দিল পাশের মাঠে। একটা মন্দির সংলগ্ন মাঠটির পূর্বে মহাসড়ক দক্ষিণ হতে উত্তরের দিকে চলে গিয়েছে। পশ্চিমে মন্দির আর উত্তরে চাষের জমি। দক্ষিণ দিকে কিছুটা হাঁটলেই গ্রাম।

বাস থামিয়ে নেমে পড়ল ড্রাইভার। যাত্রীরাও নেমে পড়ল একে একে। তিনকড়ি ঘোষ নেমেই ধুতি ধরে ছুটল মাঠের দিকে। সকালে জলখাবার খাওয়ার পর হতেই পেটটা ভুটভাট করছে। অনেকক্ষণ সামলেছিল সে। বাসটা না দাঁড়ালে যে কি হত ! তবে আর নয়, দেরি করলে কাপড়েচোপড়েই হয়ে যাবে।

এহেন চরম মূহুর্তে তিনকড়ির পথরোধ করে দাঁড়াল জগা। জগমোহন সান্যাল। সবাই অবশ্য ওকে জগাই খ্যাপা বলেই জানে। জগাই এসেছে তার প্রাক্তন প্রেমিকার নামে পিণ্ড দিতে। মাধববাবু অবশ্য জগাইকে নিয়ে আসতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, “দেখ জগাই, একে তো তুমি জ্যান্ত লোকের নামে পিণ্ডি দিতে যাচ্ছ, তারপর তুমি আবার মস্ত গোলমেলে লোক। তোমাকে নিয়ে যাওয়া খুব রিস্কের হবে।”

একগাল হেসে জগাই বলেছিল, “বুঝলেন কাকা, খদ্দের হল লক্ষ্মী আর আপনি তার প্যাঁচা। মা লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেললে লক্ষ্মীছাড়া হবেন যে।”
মাধববাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন,”তথাস্তু মা। তোমার আদেশই শিরোধার্য।”

এহেন জগাইকে সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনকড়ি বলল, “এই জগাই পথ ছাড়্।”
জগাই দাঁত বের করে হাসল। বলল,”পথ তো কারোর একার নয়। আচ্ছা বলুন তো কোন দুজনার একপথ, কোন দুজনারই বা দুইপথ আর তিনপথই বা কোন দুজনার ?”
-“জানি না যা। পথ ছাড়্ বলছি। ” কুম্ভকের চেষ্টা করল তিনকড়ি। ভেতরের পয়মাল বেরোনোর জন্য রাস্তা খুঁজছে। এ মূহুর্তে কুম্ভকই একমাত্র পথ।

জগাই হেসে বলল, “জানতাম জানেন না। ”
তিনকড়ি কঁকিয়ে উঠে বলল,”শালা, রাস্তা না ছাড়লে….. ”
আর পারল না তিনকড়ি, বসে পড়ল ওখানেই । তবে শেষরক্ষা হল না, ধুতির সম্মান বাঁচানো গেল না। দেখেশুনে নাক চেপে ধরে জগাই বলল, “পথ কারোর বাবার নয়।”

এতক্ষণে গলায় জোর এসেছে তিনকড়ির। সে গলা চড়িয়ে বলল,”পথ কার তা বোঝাব তোদের। একবার ঘরে ফিরি তারপর মামলা করব ওই মাধব মাধব দাসের এগেনেসটে। শালা ভেজাল খাইয়ে প্রাণে মারার ধান্দা করছে।”

জগাই এতে খুশি। দুনিয়ার যত বিভীষিকা, যত অদ্ভুত কিছু, যা কিছু সাধারণের ধারণার বাইরে সেসব জিনিসেই আগ্রহ ওর। জীবনে এত ধোঁকা খেয়েছে যে সহজ সরল কিছুর উপরেই ওর আগ্রহ নেই। তাই কেসকাছাড়ির কথা শুনে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করল ও।

এতকিছুর পরেও মানুষ হিসেবে খারাপ নয় জগাই। তিনকড়িকে পরিস্কার করে, ধরে ধরে নিয়ে এল বাসের কাছে। অনেকেই ঘটনাটা আঁচ করতে পেরেছিল, বাকিটুকু বুঝে গেল জগাইয়ের বর্ণনা আর তিনকড়ির তড়পানি দেখে।

মেয়েদের সামনে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করতে লাগল তিনকড়ি, “মাধব দাস…. কোথায় গেলি শালা ? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। একটা সামান্য মেয়েছেলের জন্য আমাকে মারার চক্রান্ত ! বেরিয়ে আয়…. বেরিয়ে আয়….!”

মাধববাবু জানেন যে এসময় তিনকড়ির সামনে আসা মানেই অশান্তি বাড়ানো, সুতরাং দূরে দূরেই থাকলেন। এদিকে চিৎকার করতে করতে আবার পেটে হাত দিয়ে মাঠের দিকে দৌড়ে গেল তিনকড়ি। পেছনে ছুটল জগাই।

মাধববাবু গেলেন ডাঃ গাঙ্গুলীর কাছে। ডাঃ গাঙ্গুলীও এই বাসেরই এক যাত্রী। অবসরপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার ইনি। স্ত্রীকে নিয়ে উত্তরভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন।
-“কিছু তো একটা করতে হয় ডাক্তারবাবু। যা পয়সা লাগে আমি দেব।”
চলবে….

Subrata Majumdar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *