সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগছে। এই ফাঁকা নির্জন বালিয়াড়ি, খুব অল্প কয়েকজন লোক ইতস্তত ছড়িয়ে । হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছি। আসলে নতুন দীঘার রমরমা শুরু হবার পর পুরনো দীঘার এই দিকটা বেশ ফাঁকা হয়ে যায় সন্ধ্যার দিকে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ডুবন্ত সূর্যের আলোয় এক বিষন্নতা যেন মায়াবী রূপ নিয়েছে। ভাবনাটা নিজের মনে কেমন কাব্যিক লাগলো হাসি পেল।আবার ভালোও লাগলো, সফটওয়্যার কোম্পানিতে সারাদিন ল্যাপটপ আর মোবাইল ই-মেইল এ থেকেও বাংলাটা একেবারে ভুলে যাইনি !
হঠাৎই চোখে পড়ল একাকী একটি মেয়ে, যুবতী!তখন আমার বয়স কত ?বছর আঠাশের এক টগবগে যুবক, তাই এই সময় এখানেএকটা মেয়ে দেখে কৌতূহলটা স্বাভাবিক, কারণ এই সময়ে সি-বিচ্ যে কারো পক্ষে নিরাপদ নয় ,অন্তত মেয়েদের পক্ষে তো নয় ই। কেন জানি না বাতাসে একটা আঁশটে গন্ধ! এরকম নির্জন স্থান ,সন্ধ্যের দিকে একেবারে ফাঁকা আর সেক্ষেত্রে মেয়েটির উপস্থিতি আমাকে কৌতুহলী করে তুলল। তার এলোমেলো চুল , উদাস দেহভঙ্গি যেন এক বিশেষ ভালোলাগায় ভরিয়ে দিল ,যতই হোক পুরুষ মানুষ তো !নর-নারীর এই অমোঘ আকর্ষন তো ঈশ্বরের সৃষ্টি!
কাছে এগিয়ে গেলাম ,গলা খাঁকারি দিতেই ঘুরে তাকাল । আবছা অন্ধকারে মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না তবে মনে হলো বেশ সুন্দরী। মোবাইলের টর্চ টা জ্বালাতে হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বলল ,”আলো টা বন্ধ করুন “,এ যেন অনুরোধ নয়, এ যেন নির্দেশের কন্ঠ !মজার কথা আমিও সঙ্গে সঙ্গে আলো টা বন্ধ করে নির্দেশে মানতে বাধ্য হলাম । কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু যদি মনে না করেন ,একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? “,উত্তর মেয়েটি সপ্রতিভ জবাব দিলো ,”মনে করলেও আপনার কি কিছু করার আছে? “,আমিও অপ্রস্তুত ,”না, মানে তাহলে জিজ্ঞাসা করবো না”।”বলুন ,কি বলবেন? “,মেয়েটি যত কথাই বলুক ,বসার ভঙ্গি একেবারে পাথরের মত ।আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে এ সময় আপনার থাকাটা নিরাপদ নয় জানেন?”,”জানি”, তীব্র কন্ঠে জবাব ,”তাই বলছিলাম যে চলুন হোটেলের দিকে ফিরে যাই”, মেয়েটি ঘাড় বেঁকিয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি কি করে জানলেন আমি হোটেলে যাব? “,”না ,মানে …”,আমি এবার সত্যিই খুব অপ্রস্তুত হলাম। এত রুক্ষভাবে মেয়েটি কথা বলছে মনে হচ্ছে যেন আমি ও কে অপমান করার জন্য গায়ে পড়ে কথা বলছি । তাই নিজেকে মনে মনে খুব বকলাম ,শেষে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে বললাম ,”আই এম সরি, আমার অযথা কৌতুহল দেখানো উচিত হয়নি। ওকে বাই “,বলে এগিয়ে চললাম বিচ বরাবর ।
ঘটনাটাতে হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু আগেই যে সুন্দর মনের অবস্থাটা তৈরি হয়েছিল একেবারে তছনছ হয়ে গেল, মেজাজের দফারফা। ভাবলাম আরও কিছুক্ষণ পরে হোটেলে ফিরব । এই হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়াটা আমার বড় পুরনো অভ্যেস, বাড়িতে বকা খাই কিন্তু ছাড়তে পারিনা।তাই উইকেন্ডে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে, বকখালি নয়তো শংকরপুর ,নিদেনপক্ষে কোলাঘাট । কোলাঘাট এর তরকা রুটি আর চাপ, আঃ! টের পেলাম খারাপ লাগাটা আস্তে আস্তে কমে আসছে ,চারিপাশ ততক্ষনে এক্কেবারে শুনশান । আমি ফিরতি পথ ধরে এগোতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে।কিন্তু ওই মেয়েটির সামনে দিয়ে না গিয়ে ওকে এড়াবার জন্য একটু দূর থেকে হাঁটা দিলাম । কিন্তু যেতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল সমুদ্রের মধ্যে কিছু একটা যেন জ্বলছে !আমি প্রথমে মাছ ধরার ট্রলার বা বোট জাতীয় কিছু ভেবে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু বাধ্য হলাম থমকে দাঁড়াতে!কারণ ওই আলোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল তীরের দিকে! চারিদিকে প্রচন্ড আঁশটে !গন্ধ কই যাবার সময় তো এতটা তীব্র গন্ধ পাইনি !কিসের গন্ধ এটা? সমুদ্রের তীরে ওজোন গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় জানি, কিন্তু তা এতটা তীব্র হবার কথা নয় !আমার প্রায় বমি হবার জোগাড়। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে ও পারলাম না ,চোখটা যেন আটকে গেল। ওই আলোটা লম্বাটে একটা জ্বলন্ত শিখার মতো জ্বলতে জ্বলতে উঠে এলো সৈকতের ওপরে, সোজা এগোতে লাগল মেয়েটির দিকে । আবছা বুঝতে পারলাম মেয়েটি ততক্ষনে এগোতে শুরু করেছে!
এরপর আগুনের শিখাটা এক জায়গায় কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে আবার ফিরতে লাগলো সমুদ্রের দিকে, আর মেয়েটি তার পেছু নিল। চলতে চলতে আগুনের শিখা সৈকত ছেড়ে নেমে গেল জলে !একি! আমি ভুল দেখছি নাকি? চোখ সরু করে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম, ওই আগুনের আলোয় বেশ বোঝা যাচ্ছে ওই মেয়েটি ও নেমে যাচ্ছে সোজা জলের মধ্যে। নামতে নামতে আগুনের শিখা ডুবে গেল জলের নিচে আর পেছন পেছনে মেয়েটি! আমি চিৎকার করতে করতে চেষ্টা করলাম ছুটে যাওয়ার ,কিন্তু টের পেলাম যে কিছুতেই আমি কোন শব্দ করতে পারছি না, হাত নাড়াতে চাইলাম কিন্তু মনে হল হাত পা যেন দশমণি পাথরের সঙ্গে বাঁধা,দাঁড়িয়ে রইলাম স্থানুর মতো।
শেষে ওই দুজনের আর কোনো অস্তিত্ব রইল না । সমুদ্র তার নিজের তালে ছোট ছোট ঢেউ এ এসে পড়তে লাগলো উপকূলে ,যেন কিছুই হয়নি !শুধু আমি সাক্ষী রইলাম এক অপার্থিব ঘটনার। শোনা যায় পরে জেলেরা আমাকে খুঁজে পেয়েছে সমুদ্রের তীরে অজ্ঞান অবস্থায়।