অহংকার

অহংকার  –  অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়

নাইট ক্লাবে  চলছে শনিবারের রাতের পার্টি । বাজছে ডি জে । তালে তালে নাচছে  যুবক যুবতীদের শরীর । ধোঁয়ায় আর মদের গন্ধে ভরপুর জমে উঠেছে পার্টি ।  কিন্তু  প্রেমাংশুর এসব  হৈ হুল্লোড় আর ভালো লাগছে না । তার ইচ্ছা করছে না গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াতে কিংবা প্রেমিকার বুকে মুখ ঘষতে । এক  কোণে  সোফায় গিয়ে বসে পড়লো ।

ঈপ্সিতা অনেক্ষন থেকেই লক্ষ করছে প্রেমাংশুকে । আজকের প্রেমাংশু যেন অন্য রকম । আছে অথচ নেই । খটকা লাগলো ঈপ্সিতার মনে । তাহলে কি প্রেমাংশুর শরীর খারাপ ? সে কি অসুস্থ বোধ করছে ?

ছুটে এলো ঈপ্সিতা । ধপাস করে বসে পড়লো প্রেমাংশুর পাশে ।

বলল , কি ব্যাপার চুপচাপ বসে আছ্ যে ? শরীর খারাপ ?

না না , শরীর ঠিক আছে । ভালো লাগছে না এই সব হৈ হুল্লোড় ।

হঠাৎ এরকম মতি ভ্রম ?

বলতে পারবো না । মনে হয় অনেক তো হল এবার একটু বাইরেটা দেখে আসি । জীবনের আর একটা দিক দেখার খুব সখ হয়েছে । ভাবছি কদিনের জন্য একটু কোথা থেকে ঘুরে আসি । একদম সাদামাটা ভাবে । সাধারণ মানুষের একজন হয়ে । ট্রেনে সেকেন্ড ক্লাসে । লোকাল বাসে কিংবা শেয়ার অটোতে । রাস্তার ধারে বেঞ্চে  বসে মাটির ভাঁড়ে চা । পাহাড়ি রাস্তায় এলো মেলো ঘুরে বেড়ানো । একদম একা ।

হা করে ঈপ্সিতা শুনছিল প্রেমাংশুর কথা । মেলাতে পারছে না তার এত দিনের দেখা প্রেমাংশুর সাথে । তার রক স্টার প্রেমিকের আজকে কেমন গোবেচারা কবি কবি ভাব । রাবিশ !

বলল , আমার মনে হচ্ছে সামথিং রং  উইথ ইউ । কাম অন ডার্লিং । লেটস ডান্স । সরি । আমি নাচবো না । জোর করিস  না প্লিজ ।

এমন সময় স্যান্ডি এসে হাজির । প্রচন্ড ঘেমে গেছে । চোখ দুটো লাল ।

বলল , হাই , ইটস টাইম ফর ডান্সিং ।

ঈপ্সিতা বলল , প্রেমাংশুর এসব ভালো লাগছে না ।

স্যান্ডি বলল , লেটস ডান্স টুগেদার ।

হাত বাড়িয়ে দিল ঈপ্সিতার দিকে ।ঈপ্সিতা স্যান্ডির ডাকে সাড়া  দিয়ে চলে গেল নাচতে । প্রেমাংশু দেখলো এই সুযোগ । আর দেরি করলে যাওয়া হবে না । বাড়িতে  ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে । কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বে । ট্রেনে করে । যে ট্রেন পাবে তাতেই চেপে বসবে । যেখানে ইচ্ছে করবে সেখানেই নেমে পড়বে ।

পরের দিন প্রেমাংশু যখন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালো ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে সাতটা । টিকিট কাউন্টারের সামনে খুব বেশি ভিড় নেই । ইলেক্ট্রনিক্স ডিসপ্লে বোর্ডে একগাদা ট্রেনের নাম্বার , নাম, কত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে কটার সময় ছাড়বে তার বিবরণ । আটটা পনেরো তে পূর্বা এক্সপ্রেস । নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে ।একটা জেনারেল ক্লাসের টিকিট কেটে প্রেমাংশু ঢুকে পড়লো প্ল্যাটফর্মের ভেতরে । ট্রেন দিয়ে দিয়েছে । বসার জায়গা সব ভর্তি ।

ট্রেন ছেড়ে দিল ।

একজন যাত্রী বললেন , আমি বর্ধমানে নেমে যাবো । আমার সিটে আপনি বসতে পারবেন ।

ভদ্রলোক বর্ধমানে নেমে গেলেন । প্রেমাংশু বসলো তার জায়গায় । দারুন লাগছে । এ এক নতুন অভিজ্ঞতা । সাধারণ মানুষের সাথে তাদের পাশে বসে ট্রেনে সফর করা ।  সহযাত্রীরা অধিকাংশই গরিব । শ্রমিক শ্রেণীর । এদের চেহারা , পোশাক আর কথাবার্তা শুনে প্রেমাংশুর মনে হল এরা  যেন সব অন্য  গ্রহের মানুষ । এদের সাথে প্রেমাংশুদের আকাশ পাতাল পার্থক্য ।

বাইরের প্রকৃতি অসম্ভব সুন্দর । ধুধু মাঠ । সোনালী ধানে ভরা । ধানের শীষের ওপরে এখনো যেন শিশিরের দানা লেগে আছে । হঠাৎ সেই বিখ্যাত কবিতার কটা  লাইন মনে পড়লো প্রেমাংশুর । “……. দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া / একটি ধানের শীষের উপরে / একটি শিশির বিন্দু ।”

মধুপুর ছেড়ে এসেছে । ট্রেন ছুটে চলেছে জসিডির দিকে । প্রেমাংশু ঠিক করলো সে দেওঘর যাবে |কেন যাবে ? তা সে জানে না । হঠাৎ ইচ্ছা হল তাই যাবে ।

দেওঘরে এসে উঠলো একটা অতি সাধারণ হোটেলে ।দুপুর বেলায় খাওয়ার পরে এক টাঙ্গায়ালা র সাথে কথা বলে নিল । যে কদিন দেওঘরে থাকবে , তার টাঙ্গাতেই ঘুরবে । ঠিক বিকেল তিনটের সময় টাঙ্গায়ালা এসে হাজির । বেরিয়ে পড়লো প্রেমাংশু । টাঙ্গায়ালার  সাথে গল্প করতে করতে পৌঁছে গেল নন্দন পাহাড়ে। টাঙ্গায়ালার নাম শিবপ্রসাদ । খুব ভালো গল্প বলতে পারে ।

বলল , মহাদেবের অনুচর নন্দীর নামেই এই পাহাড়ের নাম । মহাদেব নন্দীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পাহাড়ের প্রবেশ পথের দ্বাররক্ষী হিসাবে । রাবন ঢুকতে গিয়ে বাধা পায় । ক্রোধে নন্দীকে নিক্ষেপ করেন পার্শ্ববর্তী পুস্করিণীতে । সেই থেকেই এই পাহাড়ের নাম নন্দী পাহাড় । লোক মুখে নন্দী থেকেই নন্দনের উৎপত্তি ।

টাঙ্গা থেকে নেমে প্রেমাংশু পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল পাহাড়ের ওপর দিকে । তার মতে এটাকে পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভালো । তবে পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখে মন ভরে যায় । অনেকটা এলোমেলো হেঁটে প্রেমাংশু নেমে এলো নিচে । একটু দূরে একটা চায়ের দোকান । প্রেমাংশুর মনে হল এক কাপ গরম চা হলে মন্দ হয় না । এগিয়ে গেল দোকানের দিকে । আর ঠিক তখনই তার নজরে পড়লো টাঙ্গায়ালা কার সাথে যেন কথা বলছে আর তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কি যেন বলছে ।

দাঁড়িয়ে পড়লো প্রেমাংশু । টাঙ্গায়ালা  ভদ্রলোককে নিয়ে এগিয়ে এলো । ভদ্রলোকের পেছনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রমহিলা । তার সাথে দুটো ছেলে । ছেলে দুটোর বয়স খুব বেশি হলে ছয় -সাত হবে ।  চারজনই রোগাটে চেহারার । পুষ্টির অভাব । পরনের পোশাক ও মলিন । ক্লান্তির ছাপ  সারা চোখে মুখে ।

টাঙ্গায়ালা  বলল , ইয়ে আদমি আপকা  সাথ বাত  করনা চাহাতা হ্যায় ।

লোকটা হাত জোড় করে বলল , নমস্কার । আমার নাম দীননাথ গোস্বামী ।

পাশের মহিলাকে দেখিয়ে বলল , ইনি  আমার স্ত্রী আর সাথে আমাদের দুই ছেলে ।

প্রেমাংশু বলল , বলুন , কি বলবেন ?

দীননাথ বাবু বললেন , একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন ?

বেশ , বলুন ।

আমরা অনেক্ষন আগে এখানে এসেছি । হেঁটে  হেঁটে ।

প্রেমাংশু জিজ্ঞেস করলো , কোথায় উঠেছেন আপনারা ?

টাওয়ার চকের ওখানে যে কালী মন্দিরটা আছে তার পেছন দিকে ।

সে তো অনেকটা রাস্তা ।

হ্যাঁ । কি করবো বলুন ? আমাদের মত গরিব মানুষের পক্ষে গাড়ি ভাড়া করা মানে বিলাসিতা ।

প্রেমাংশু বলল , এখন বলুন কি বলতে এসেছিলেন ?

ভদ্রলোক একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন , টাঙ্গায়ালা  বলল আপনি টাওয়ার চকের দিকেই যাবেন । যদি অসুবিধে না হয় আমার ছেলে দুটোকে একটু আপনার সাথে  নেবেন ?

আর আপনারা ?

আমাদের অভ্যাস আছে । হেঁটে চলে যাবো ।

একা একাই  ঘুরবে ঠিক করেছিল প্রেমাংশু । বাচ্চা দুটোকে দেখে খুব খারাপ লাগলো । দেখে মনে হচ্ছে এখানেই বসে পড়বে । ব্যাচারা ! অভাবী মানুষের কষ্টের প্রথম ছোঁয়া  পেল প্রেমাংশু ।

বলল , ঠিক আছে । আসুন ।

চলতে শুরু করলো টাঙ্গা ।

দীননাথ বাবু বললেন , আপনি আমাদের যা উপকার করলেন তা জীবনে কোনদিন ভুলবো না ।

এই কথার কোন উত্তর না দিয়ে প্রেমাংশু বলল , আপনারা কোথা  থেকে এসেছেন ?

কলকাতা । বেহালায় থাকি । আমার একটা ইমিটেশনের দোকান আছে । রাস্তার ধারে  একটা গুমটি ঘরে । ওই ঘরটার জন্য আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পার্টিকে দিতে হয়েছে ।আমার মতন মানুষ পঞ্চাশ হাজার টাকা কোথায় পাবো ? আমার বাবা একটা মুদির দোকানে কাজ করতেন । আমি একমাত্র ছেলে । বেকার ছেলে ।

দুর্ভাগ্য কাকে বলে । একদিন দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে একটা অটো পেছন থেকে বাবাকে ধাক্কা মারে । মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় বাবা । কাছেই ছিল একজন ডাক্তারের চেম্বার । প্রাথমিক চিকিৎসা করে ডাক্তারবাবু বাবা কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন । নিয়ে গেলাম পিজি হাসপাতালে । দিন সাতেক ছিল । তারপর বাড়ি ফিরে  এলো । দু বগলে দুটো ক্র্যাচ । বুঝতেই পারছেন বাবার কাজটা গেল । ভাবলাম বাবার কাজটা হয়তো আমি পাব । গেলাম দোকানদারের কাছে । তিনি ইতিমধ্যে অন্য  একজন কে রেখে দিয়েছেন । মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো । সংসার চলবে কিভাবে ?

গরিবের কষ্ট আপনারা বুঝবেন না । সংসারে শুধু অভাব আর অভাব । বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে যাচ্ছে । বাড়িয়ালা নোটিশ ধরিয়ে দিল । হাতে পায়ে ধরলাম । শুনলো না । ঘটি বাটি  বেচে বাড়িভাড়া মিটিয়ে চলে গেলাম বস্তির দিকে । বারো ঘর এক উঠোন এ রকম একটা ঘর সস্তায় ভাড়া পেলাম । হন্যে হয়ে ঘুরলাম একটা কাজের জন্য । কিন্তু কোথায় কাজ ? কে দেবে আমাকে কাজ ?

একটা কথা বলা হয় নি আপনাকে । বছর দুয়েক ধরে নিরূপা মানে আমার স্ত্রীর সাথে আমার আলাপ । তখন অবশ্য বিয়ে হয় নি । নিরুপাদের সংসারেও অভাব ।  সপ্তাহে সপ্তাহে দেখা হত রেশন দোকানে । সেখান থেকেই আলাপ । তারপরে প্রেম । ভাবুন সাহস ? যার এক পয়সা আয় করার মুরোদ নেই সে করে প্রেম । বিয়ে করে বৌকে খাওয়াবো কি ? ওদিকে নিরুপার বিয়ে হবার কোন সম্ভাবনা নেই । অনেকগুলো ভাইবোন । সংসারই চলে না তো মেয়ের বিয়ে দেবে কি ভাবে ? নিরুপার দাদু নাতনির বিয়ের জন্য কিছু টাকা পোস্ট অফিসে রেখেছিলেন । সেই টাকাটা পঞ্চাশ হাজার হয়েছে । নিরূপা আমাকে বলেছিল কোনো ছেলে যদি তাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বাবা তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা যৌতুক দেবে ।

লাফিয়ে উঠলাম আমি । বাড়িতে সব জানালাম । দুই বাড়িতে  সবাই রাজি । বিয়ে হল । যৌতুকের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে গুমটি ঘরটা পেলাম । একটা ইমিটেশনের দোকান দিলাম । কিছু টাকা ধার করতে হল ।

বুঝতেই পারছেন গুমটি ঘরে কত আর বিক্রি । প্রচন্ড কষ্টে দিন কাটাই । আমার বৌটা বড্ড ভালো মেয়ে । দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে । বাড়ির সব কাজ করে একার হাতে । কোন অভিযোগ নেই । কিছুই দিতে পারি না । বছর শেষে একটা শাড়ি পর্যন্ত দিতে পারি না । বিশ্বাস করুন খুব খারাপ লাগে ।

কেঁদে ফেললেন দীননাথ বাবু । পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেল ।

বাচ্চা দুটোর মধ্যে ছোটটা বলল , মা জল খাবো ।

প্রেমাংশুর হঠাৎ খেয়াল হল যে তার ব্যাগের ভেতরে কেক বিস্কিট মিষ্টি রয়েছে ।

বাচ্চাটাকে  বলল , তোর খিদে পেয়েছে ?

ছেলেটা তার মায়ের দিকে তাকালো ।

ছেলেটির মা ইশারা করে না বলতে বলছিল । প্রেমাংশুর নজর এড়ায় নি ।

সে বলল , আচ্ছা , আপনারা দেওঘরে কি এই প্রথম এলেন ?

ভদ্রমহিলা বললেন , না । এই একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা প্রতিবছর আসি ।

তাহলে তো দেওঘরের বিখ্যাত প্যাড়া খেয়েছেন ?

দীননাথ বাবু বললেন , না , ওটা খাওয়া হয় নি । প্রতিবারই ভাবি কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে আসি ।

ব্যাগ থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা বের করে প্রেমাংশু ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বলল ,     নিন । সবাইকে ভাগ করে দিন । আগে ছোটদের দিন তারপরে আমরা ।

ভদ্রমহিলা আর কথা বলার কোন সুযোগ পেলেন না । ভাগ করে দিলেন সবাইকে । প্রেমাংশু দেখলো ভদ্রমহিলার চোখ দুটো চিকচিক করছে । সবাইকে দেবার পরেও অনেকগুলো সন্দেশ ছিল । ভদ্রমহিলা প্যাকেটটা প্রেমাংশুকে দিতে গেলে সে বলল ,

ওটা আপনার কাছে থাক । বাচ্চারা পরে আবার খাবে ।

কথা বলতে বলতে রামকৃষ্ণ মিশনের গলিটা এসে গেল ।

দীননাথ বাবু বললেন , সন্ধ্যে বেলায় মিশনের আরতি  দেখেছেন ?

প্রেমাংশু বলল , না । দেখি নি ।

দেখবেন ? আর একটু বাদেই শুরু হবে । গলি দিয়ে একটু গেলেই রামকৃষ্ণ মিশন ।

টাঙ্গায়ালা  বলল , আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি ।আপনারা ঘুরে আসুন ।

এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা । কোন পুজোআচ্চা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রেমাংশু কোন দিন যায় নি । ইচ্ছাই জাগে নি । বেলুড়ে এমন কি দক্ষিনেশ্বরেও যায় নি । এই প্রথম । ঠাকুর  রাম কৃষ্ণের মুখোমুখি বসে এক অদ্ভুত অনুভূতি । কেমন যেন আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লো । অসম্ভব ভালো লাগছে সব কিছু । চরম মানসিক প্রশান্তি । তারা বংশ পরম্পরায় বিত্তশালী । সে প্রাচুর্য দেখেছে । এত বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছে যে অর্থই সুখ দেয়  । শান্তি দেয়  ।সেই বিশ্বাসে আজ ফাটল দেখা দিল । ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সামনে বসে মনে হচ্ছে জীবনের চরম শান্তি এখানে । নিজেকে উজাড় করে দেওয়া যায় । দরিদ্র মানুষের , অভাবী মানুষের সেবার মধ্যেই রয়েছে আনন্দ । বাকি সব মেকী । লোক দেখানো । আজ সন্ধ্যা আরতি  দেখতে না আসলে তার এই বোধ মনে হয় কোনদিন আসতো  না ।

ফেরার পথে ভদ্রমহিলা আবদার করলেন তাদের ঘরে একবার যাওয়ার জন্য ।

বললেন , দাদা , আপনি আমাদের জন্য এত করলেন এক কাপ চা অন্তত এই গরিব বোনটার  ঘরে এসে খেয়ে যান ।

না বলতে পারলো না প্রেমাংশু ।

কালী মন্দিরের সামনে এসে টাঙ্গায়ালাকে  বলল ,আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন । আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো ।

মন্দিরের পেছন দিকে পায়ে চলা সরু রাস্তা । আগাছার জঙ্গল । আলোর ছিটে ফোঁটা  নেই । ভুতের মতন এগিয়ে চলা । চারি পাশটা ফাঁকা । মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই । গা ছমছম করে । অবশেষে একটা টালির চালার  সামনে এসে থামলো । ভদ্রমহিলা  আঁচলের গিট্ খুলে চাবি নিয়ে দরজার তালা খুললেন । ভেতরটা অন্ধকার । ক্যারোসিন তেলের বিশ্রী গন্ধ । দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম । ভদ্রমহিলা হাতড়ে হাতড়ে  দেশলাই খুঁজে পেলেন । একটা কুপি জ্বালালেন । অস্পষ্ট আলোয় ভরে গেল ঘরটা । এটা  রান্না ঘর । রান্নার বাসনপত্র আর কেরসিন তেলের একটা স্টোভ রয়েছে একটা বেঞ্চের ওপর । দেওয়ালে কাঠের তাকে  কিছু কৌটো । শিশি বোতল । মশলাপাতি । একটাই শোবার  ঘর । ঘর জুড়ে একটা তক্তপোষ । তুলো বেরকরা তোষক । নোংরা চাদর । বিছানার ওপর ঢাই করে রাখা ছেড়ে যাওয়া জামা কাপড় । রান্না ঘরে একটা বাল্ব ঝুলছে । কিন্তু ওটা জ্বলে না । বিছানা ছাড়া বসার কোন জায়গা নেই ।ভদ্রমহিলা স্টোভ জ্বালাতে গিয়ে খেয়াল করলেন যে স্টোভে তেল নেই ।

স্বামীকে বললেন , তেল না আনলে রাতে রান্না হবে না । এখন চা করবো কি করে ?

ভদ্রলোক বললেন , যাই দেখি তেলের দোকান খোলা পাই কিনা ।

প্রেমাংশু হতবাক !

মুখ ফস্কে বলে ফেলল , তেল না পেলে রাতের খাবার কি হবে ?

ভদ্রমহিলা বললেন , না খেয়ে থাকা আমাদের অভ্যাস আছে । ছেলেদেরকেউ শিখিয়েছি । আমরা গরিব । সব সময় খিদে পেয়েছে বলবে না । তবে জল তেষ্টা পেলে জল খাবে ।  অভাবের সংসারে গরিব মা তার ছেলেদের আর কি শেখাবে বলুন ? খুব খারাপ লাগছে   আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারলাম না । ভাবুন আমাদের অবস্থা ।

অভাব কাকে বলে জানা ছিল না প্রেমাংশুর । এই প্রথম দেখলো । সে জানে না তার কি করা উচিত । হাজার হাজার টাকা তারা ফুর্তি করে ওড়ায় আর একদল মানুষ একটু কেরোসিন তেলের অভাবে রাতে না খেয়ে থাকে ।

হাতজোড় করে বিনয়ের সাথে প্রেমাংশু ভদ্রমহিলাকে বলল , যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি । আমার ব্যাগে কিছু কেক বিস্কুট আছে । বাচ্চাদের দেব ?

ভদ্রমহিলা দৃঢ় স্বরে বললেন , না । অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে । আজকে আপনি দেবেন কিন্তু কালকে কি হবে ? তার পরের দিন ? তার পরের দিন ?

এই ভাবেই অভ্যস্থ হতে দিন ওদের । জানেন, সারা বছর কাজ করি শুধু বছরে এই সাতটা দিনের জন্য । একটু বেড়াতে আসি । ভালো লাগে । অভাব তো রয়েছে সারা জীবন । আমাদের এক পরিচিত মানুষের বাড়ি । বিনা পয়সায় থাকতে দেন । সারা বছর আমি একটু একটু পয়সা লক্ষীর  ঘটে জমাই । সেইটা ভেঙে চলে এই সাতটা দিন । অভাব আছে ঘরে আছে । বাইরের লোককে দেখাবো কেন ? গরিবের ওটাই অহংকার । আপনার পায়ে পড়ি আপনি আমাদের ওই অহংকারটুকু নষ্ট করে দেবেন না ।

প্রেমাংশুর দুচোখে জল । আর দাঁড়ালো না । যেভাবে এসেছিল ঠিক সে ভাবেই চলে  গেল ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *