অমঙ্গলে ঘেরা মঙ্গল — অভীক পোদ্দার

অমঙ্গলে ঘেরা মঙ্গল --  অভীক পোদ্দার

আত্মআলাপনী

কৃত্রিম প্রযুক্তি কি আদেও প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে সক্ষম? আসুন দেখে নেওয়া যাক আদতে প্রযুক্তি ও প্রকৃতির যুদ্ধে কে জয়ী হয়?

সালটা 2045। পৃথিবীতে আজ যেন কৃত্রিমতার লড়াই। চারিদিকে প্রকৃতির ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না। আর চোখে পড়বেই বা কিকরে চোখটাই যে আজ কৃত্রিম। দৃষ্টিকে আরো শক্তিশালী করবার জন্য সব মানুষের চোখে বসানো হাই ডেফিনেশন লেন্স। আমরা যারা 90 এর দশকে জন্মগ্রহণ করেছি তারা এ পরিবর্তনের প্রধান সাক্ষী। আমরা দেখেছি পৃথিবী  কিভাবে প্রাকৃতিক থেকে ধীরে ধীরে কৃত্রিম রূপ ধারণ করেছে। যদিও সবটাই আধুনিক বিজ্ঞানসাধনার ফল। মানুষ যেন আজ মানুষেরই সৃষ্ট রোবট। ফুল, ফল, গাছপালা, লতাগুল্ম সবই আজ কৃত্রিম এমনকি বায়ুচলাচল পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বায়ুতে ঠিক কি উপাদান কি পরিমানে থাকলে তা মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যকর তা যন্ত্র দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। এমনকি বিজ্ঞানীরা খাদ্য ও জলসঙ্কট-ও ঘোচাতে সক্ষম হয়েছে।

একরকমের সাফনওয়েড  ট্যাবলেট একবার খেয়ে নিলেই ব্যাস মোটামুটি 12 ঘন্টার জন্য খিদে-তৃস্না থেকে নিশ্চিন্ত। বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর মধ্যে আজ অস্ত্রের লড়াই অপরিলক্ষত। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে আক্রমিত যুদ্ধ একপ্রকার যেন লেগেই থাকে, যদিও সব দেশই তা প্রতিরোধের জন্য পূর্ব হতেই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। আমি জর্জ হেকেনসন, বিশ্বের এক বৃহৎ দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানী। আর সেই জন্যই এই আমূল পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। চাঁদের মাটি মানুষের কাছে আজ নেহাতই বিদেশ ভ্রমণের মতন। এমনকি অনেক ধনী ব্যাক্তি তো তাদের বিবাহ পর্যন্ত চাঁদে সেলিব্রেট করেন। অনেক ব্যবসায়ী তো ছোট খাটো কয়েকটি হোটেল-রেসট্রুরেন্ট এমনকি স্টেডিয়াম করে সেখানে বেশ জাকিয়ে বসেছেন। এত উন্নত প্রযুক্তির পরেও মঙ্গল মানুষের কাছে আজও অজেয় ও বিভীষিকাময়। যাক সেসব কথা।
যে কথা বলার জন্য মূলত এসবের সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটানো তা  এইবারে বলে ফেলা যাক। আজ একটু আগেই আমার ল্যাবের সুপারকম্পিউটারে একটি মেল আসে। মেলটি করেন প্রফেসর রজার স্টিফেন। দুবছর যাবৎ প্রত্যেক বছর এই সময় তিনজন মহাকাশ বিজ্ঞানীকে মঙ্গলের রহস্যভেদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। এবছর সেই অভিযাত্রীর তালিকায় আমার নাম সিলেক্টেড। মঙ্গল অভিযানে আমার সঙ্গী মি. স্টিফেন এবং মি. হুডসন। এর আগে দু একটা ছোট মিশনে আমি এনাদের এসিস্টে কাজ করেছি। তাই আমাদের পরিচয় বেশ অনেকদিনের। মি. স্টিফেন ও মি. হুডসন নিঃসন্দেহে খুব বড় মাপের মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং প্রখর বুদ্ধিধারী। মঙ্গলোভিযানে সিলেক্ট হওয়ার পর এখন আমার মন বেশ উৎফুল্ল, কিন্তু সত্যি বলতে একটা চাপা ভয় যেন সেই উৎফুল্লতার ওপর রাশভারী চাদর মুরে দিচ্ছে ক্রমাগত।
আসলে গত দু বছর যে তিন-তিন ছয় জন বিজ্ঞানী মঙ্গল অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন তারা কেউই এর পৃথিবীতে ফিরে আসেনি। মঙ্গলের মাটিতে ল্যান্ডের পরই নাকি কন্ট্রল রুমের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন সম্ভবপর হয় নি। তাই এবার খানিকটা তদন্তের খাতিরেই নাকি আমাদের মঙ্গল অভিযান। আগামী পরশু রাত 9 টায়
ইন্টারন্যাশনাল এসট্রনটিক লিমিটেড থেকে মঙ্গলের উদ্দ্যেশ্যে আমাদের স্পেসশিপের যাত্রা শুরু।নির্দিষ্ট দিন ঠিক সময় আমরা তিনজনই পৌঁছে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল এসট্রোনটিক লিমিটেডের মূল কক্ষে। সেখানেই এই সংস্থার কর্ণধার মি. হ্যামিলটন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মহাকাশ ভ্রমণের পদ্ধতি আমাদের তিনজনেরই জানা। তাই প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী সংগ্রহের পর আমরা উঠে পড়লাম আমাদের মঙ্গল যাত্রার স্পেসশিপে।
মি. হ্যামিলটন আমাদের বেস্ট অফ লাক বলে বিদায় জানানোর পর স্পেসশিপের চালক মি. হুডসন যান্ত্রিক সুইচে চাপ দিলেন, আর তার প্রায় সাথে সাথেই প্রচন্ড শব্দের সাথে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।মঙ্গল হল সূর্য থেকে দূরত্বের হিসাবে চতুর্থ তথা বুধের পরেই সৌরজগতের দ্বিতীয়-ক্ষুদ্রতম গ্রহ। বাংলা সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় এই গ্রহটি এক হিন্দু গ্রহদেবতার নামাঙ্কিত। ইংরেজি মার্স (“Mars”) নামটি এসেছে রোমান পুরাণের যুদ্ধদেবতা মার্সের নামানুসারে। এই গ্রহের পৃষ্ঠতলে আয়রন অক্সাইডের আধিক্যের জন্য গ্রহটিকে লালচে রঙের দেখায়, যা খালি চোখে দৃশ্যমান মহাজাগতিক  বস্তুগুলির মধ্যে এই গ্রহটিকে স্বতন্ত্রভাবে দর্শনীয় করে তোলে। সেই জন্য এই গ্রহটি “লাল গ্রহ” নামেও পরিচিত। মঙ্গল একটি শিলাময় গ্রহ। এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল ঘনত্বহীন এবং পৃষ্ঠভাগের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে চাঁদের মতো অভিঘাত খাদ যেমন দেখা যায়, তেমনই পৃথিবীর মতো উপত্যকা, মরুভূমি ও মেরুস্থ হিমছত্রও চোখে পড়ে।
পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব প্রায়  205.08 মিলিয়ন কিলোমিটার। আমাদের স্পেসশিপের গতিবেগ 160.26 কিমি/সেকেন্ড অর্থাৎ ঘন্টায় 360000 মাইল। সেই অর্থে মঙ্গলের মাটিতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় 14 দিন সময় লাগার কথা। আমার ব্যাগে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে উপযুক্ত পরিমান ক্ষিদা-তৃস্না নাশক সাফনওয়েড ট্যাবলেট, প্রযুক্তিগত ক্যামেরা, খুব সূক্ষ তরঙ্গ ধরা রেকর্ড মেশিন, দুটি লেজার গান যা কিনা জল দ্বারা গঠিত যে কোনো প্রাণীকে নিমেষে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম, আর মৌলিক কিছু যন্ত্রপাতি। যাত্রার প্রথমদিকে মি. হুডসন স্পেসশিপ কন্ট্রোলের দায়িত্বে থাকলেও বেশ কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর আমরাও তার দায়িত্ব সামলাচ্ছিলাম। আমাদের মহাকাশযানের নাম সয়াজ। এই মহাকাশযান প্রধানত তিনজন মহাকাশচারী বহনে সক্ষম।
এর রয়েছে প্রধান তিনটি অংশ যথা অরবিটাল মডিউল, ডিসেন্ট/রিএন্ট্রি মডিউল এবং সার্ভিস মডিউল। অরবিটাল মডিউলটি প্রায় 1300 কেজি  ভরের, সবচেয়ে উপরে অবস্থিত উপগোলাকার আকৃতির একটি অংশ। যার দৈর্ঘ্য 2.6 মি. এবং সর্বোচ্চ ব্যাস 2.2 মি.। এ মডিউলটিতে মহাকাশচারীরা অরবিটে অবস্থানের সময় বসবাস করেন। এর উপরের দিকে রয়েছে ডকিং নব। মাঝের অংশটি প্রায় 2900 কেজি ভরের ডিস্টেন্স মডিউল। যার দৈর্ঘ্য 2.1 মি. এবং ব্যাস 2.2 মি.। এই অংশটি মহাকাশ অভিযানের শেষে মহাকাশচারীদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবহৃত হয়। রিএন্ট্রির সময় সয়াজের সার্ভিস মডিউল এবং অরবিটাল মডিউলটি, ডিসেন্ট মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং বায়ুমণ্ডলে ভস্মীভূত হয়। যাতে রিএন্ট্রির সময় মডিউলটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাই এতে হিট শিল্ড থাকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর এর গতি কমানোর জন্য প্যারাস্যুট খুলে যায়, সলিড ফুয়েল রকেট খুলে যায় এর গতি  শুন্যে আনার জন্য।
সার্ভিস মডিউলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাবস্থা, লং রেঞ্জ রেডিও কমিউনিকেশন, রেডিও টেলিমেট্রি, ওরিয়েন্টেশন এবং কন্ট্রোল ইন্সট্রুমেন্ট রয়েছে। সার্ভিস মডিউল অংশে প্রধান ইঞ্জিন এবং অরবিটে মেনুভারের জন্য লিকুইড ফুয়েল প্রোপালেশন সিস্টেম রয়েছে। আমাদের সফরের প্রথম কদিন তেমন কিছুই ঘটলো না। কিন্তু শেষের দিকে জানালার কাঁচ থেকে দেখলাম প্রকৃতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত। মঙ্গল গ্রহের প্রাকৃতিক উপগ্রহের সংখ্যা দুই। এগুলির নাম হল ফোবোস ও ডিমোস। এই উপগ্রহ দু-টি আকারে খুবই ছোটো ও অনিয়তাকার। সম্ভবত এই দু-টি মঙ্গল ট্রোজান ৫২৬১ ইউরেকার মতো মঙ্গলের অভিকর্ষজ টানে আটকে পড়া দু-টি গ্রহাণু। যথাসময়ে আমাদের  স্পেসশিপ মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুর মাটিতে ল্যান্ড করলো। মি. হুডসনকে স্পেসশিপে অপেক্ষা করতে বলে আমি ও মি. স্টিফেন মঙ্গলের মাটিতে পদার্পন করলাম।  মঙ্গলের পৃষ্ঠভাগে তরল জলের অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
কারণ, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ খুবই কম, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১% মাত্র। সবচেয়ে কম উঁচু স্থানগুলি অল্প সময়ের জন্য তা বাড়ে মাত্র। মেরুস্থ হিমছত্র দু-টি প্রধানত জল দ্বারাই গঠিত।দক্ষিণ মেরুর হিমছত্রটিতে জলীয় বরফের পরিমাণ এতটাই যে, সেই বরফ গলে গেলে সমগ্র গ্রহের পৃষ্ঠভাগ ১১ মিটার (৩৬ ফু) গভীর জলের আস্তরণে ঢুবে যাবে। চারিদিকে লাল রঙের অনুচ্চ টিলা এবং শুস্ক মাটি আমাদের চোখকে মোহিত করলো। আমরা সম্ভবত মঙ্গলের রাত্রিকালে অবতীর্ণ হয়েছি আর সেই কারণেই হয়তো চারিদিক প্রায় অন্ধকার বললেই চলে। মি. হুডসন ইতিমধ্যেই রেডিও ট্রান্সমিশন মারফত আমাদের সংস্থায় স্পেসশিপের ল্যান্ডিং-এর খবর পৌঁছে দিয়েছে। মঙ্গলে অবতরিত হয়েই আমরা প্রথমে সেখানকার মাটির কিছুটা  স্যাম্পল সংগ্রহ করলাম।
তারপর ধীরে ধীরে সেখানকার আবহাওয়া পরীক্ষা করলাম। আমাদের সকলের কাছেই নিজেদের সাথে সংযোগকারী যন্ত্র রয়েছে। যেহেতু মঙ্গলে আমরা মাত্র 9 ঘন্টা থাকবো তাই আমরা ঠিক করলাম মি. স্টিফেন মঙ্গলের একদিকে এবং আমি অন্য দিকে পরীক্ষা চালাবো এবং প্রয়োজনে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখবো। মঙ্গলের এই দিকটা বেশ অন্যরকম। কিছুটা এগোতেই চোখে পড়লো লাল মাটি নির্মিত এক বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের ওই প্রান্তে কি আছে তা ঠিক অনুমান করতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই মি. হুডসন-ও স্পেসশিপ থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এসেছেন। কিছুদূর অন্তর খাদের চারিপাশে ছোট ছোট খাদের অস্তিত্ব বর্তমান। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটলো। একসময় হঠাৎ মি. স্টিফেন আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলেন।
কিন্তু হয়তো যান্ত্রিক কারণবসত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। কিছুক্ষন যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টার পরও যখন মি. স্টিফেনের কোনো খোঁজ মিললো না তখন আমরা দুজনে ঠিক করলাম মি. হুডসন আমাদের জন্য স্পেসশিপের কাছেই অপেক্ষা করবেন এবং আমি ওই দিকে মি. স্টিফেনকে সাহায্যের  জন্য অগ্রসর হবো। তারপর আমি ধীরে ধীরে মি. স্টিফেনের পরীক্ষামূলক নির্দিষ্ট দিকে এগোতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষন কাটানোর ফলে অন্ধকারে চোখ প্রায় সয়ে এসেছে। এগোতে এগোতেই বুঝতে পারলাম এদিকের প্রকৃতি একদম ভিন্ন ধরনের। কিছুদুরেই পাভনিস মনস আগ্নেয়গিরির ধূলাবলি সম্মিলিত একটি অংশকে দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে মঙ্গলের এই জায়গাটিই নাকি প্রাণ ধারণের জন্য সর্বাধিক উপযোগী। বিজ্ঞানীমহলের একাংশের অনুমান এই স্থানের গর্তের নিচে প্রায় 35 মি. জুড়ে ভূগর্ভস্থ গুহা রয়েছে। সত্যি বলতে এত উন্নত প্রযুক্তি সত্ত্বেও সেদিকে এগোতে কিছুটা ভয় হলো। কিছুক্ষন পরই সেই গর্তের একদম কাছে চলে এলাম।
বেশ কয়েকবার মি. স্টিফেনের নাম ধরে ডাকার পরেও যখন কোনো সাড়া মিললো না তখন ভাবলাম উনি কি তবে পা হরকে এই গর্তে পরে গেছেন! ঠিক করলাম আমি এই গর্তে নেমেই অনুসন্ধান চালাবো। মি. হুডসনকে কানেক্ট করে সেই নির্দেশ দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে উনি উপযুক্ত দড়ি নিয়ে হাজির হলেন। দড়ির একপ্রান্ত একটি ভারী পাথরের সাথে অন্য প্রান্ত কোমরে বেঁধে নিলাম। এখন আমার একহাতে টর্চ ও অন্যহাতে লেজার গান। পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ায় পর ধীরে ধীরে গহ্বরে প্রবেশ করলাম। বিশাল গহ্বরের মধ্যে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হলো।
 এখানকার মাটি খুব নরম। একসময় গর্তের নিচের দেওয়ালে হাই পাওয়ারের টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম সেখানে পরিষ্কার ইংরেজিতে কি যেন লেখা। কাছে যেতেই ধীরে ধীরে লেখাটি আমার কাছে স্পষ্ট হলো। ইংরেজিতে লেখা ‘GO AWAY’ অর্থাৎ চলে যাও। মনে কৌতূহল নিয়ে সাহস করে কিছুটা এগোতেই একজায়গায় চোখ স্থির হয়ে গেল। হাড়হিম করা সেই দৃশ্য দেখেই শরীর ভয়ে কেঁপে উঠলো। মনে হলো গলার শেষ জলবিন্দুটা যেন এই মাত্র কেউ শুষে নিলো। সামনে পরে রয়েছে মি. স্টিফেন সহ আরো 5 জনের রক্তশূন্য   মৃতদেহ। কেউ যেন খুব হিংস্রতার সাথে তাদের চোখ মুখ খুবলে নিয়েছে, কিন্তু অবাক বিষয় তাতে রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই। এমতবস্থায় কি করবো ভাবছি এমন সময় সামনে থেকে কুই কুই আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি কয়েকটি কিংভূতাকৃতি প্রাণী আমার দিকেই ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। তাদের চেহারা অনেকটা আমাদের বানানো এলিয়েনের মতন শুধু সেগুলো থেকে একধরনের লালারস নিঃসৃত হচ্ছে। আমি দিক্বিদিকশুন্য হয়ে ছুটে গেলাম
দড়ির দিকে। তারপর কোনোভাবে কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে উঠতে থাকলাম ওপরের দিকে। অর্ধেক উঠতেই টের পেলাম গর্তটি মৃদু নড়ে উঠলো।
চারপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝলাম এটি আসলে কোনো গর্ত নয় এটি একটি বিশাল আকারের প্রাণীর মুখগহ্বর এবং আমার দেখা ভিতরের প্রাণীগুলি আসলে তারই জিহ্বার অংশ। তড়িঘড়ি কোনো মতে ওপরে উঠে এলাম। আমার বিস্মিত ভাব দেখে মি. হুডসন-ও কিছুটা ভয় পেলেন। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে আমরা ছুটলাম আমাদের স্পেসশিপের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের রেডিও মাধ্যম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ছুটতে ছুটতে মি. হুডসনকে বললাম যেভাবেই হোক আমাদের স্পেসশিপে উঠতে হবে। বুঝতে পারলাম সেই দানবাকৃতি প্রাণী ইতিমধ্যেই আমাদের পিঁছু ধাওয়া করেছে।
মি. হুডসনের পায়ের সম্যসা থাকায় উনি বেশি জোরে ছুটতে পারছিলেন না। হঠাৎ মি. হুডসনের ভয়মিশ্রিত আর্তনাদ শুনে পিছনে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম সেই দানবের জিহ্বা মি. হুডসনের পা জড়িয়ে ধরেছে। তৎক্ষণাৎ সেই জিহ্বা লক্ষ্য করে আমার লেজার গানের বাটন টিপলাম। বাটন প্রেসের সাথে সাথেই সূক্ষ তীব্র লেজার আঘাত হানলো সেই জিহ্বার ওপর। অবাক হয়ে দেখলাম লেজার সুটের  পরেও সেই প্রাণীর কোনো ক্ষতিই হলো না। আরও দুএকবার সুটের পরেও যখন একই ফলাফল ঘটলো তখন বুঝলাম এই প্রাণী নিশ্চয় জলদ্বারা নির্মিত নয়, এ যেন প্রকৃতির সৃষ্ট ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রাণী। এমন সময় লক্ষ্য করলাম আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন সেইদিকে চেয়ে আছি হঠাৎ বুঝতে পারলাম ধীরে ধীরে জিহ্বার চোষকগুলি আমাকে আষ্টেপিষ্টে ধরছে। অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে থাকলাম প্রযুক্তির উন্নতির কথা। এই প্রথম বুঝতে পারলাম প্রকৃতির কাছে এসব উন্নত প্রযুক্তি খুবই তুচ্ছ বিষয়। প্রকৃতি চাইলে যে কোনোদিন এসব উন্নত প্রযুক্তিকে কালগ্রাসে নিমেষেই হজম করতে পারে।।
তাই মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রকৃতির শরণাপন্ন হওয়াই একমাত্র পথ।।
  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *